1. স্মরণীয় বরণীয়

মুন্শী রইস উদ্দিন (১৯০১-১৯৭৩)

প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ একাধিক সংগীত গ্রন্থের প্রণেতা ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিন মাগুরা জেলার কৃতি সন্তান। ১৯০১ সালের জানুয়ারির কোনো একদিন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন নাকোল গ্রামেজন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুনুশী আব্বাস উদ্দিন এবং মাতার নাম জোবেদা খাতুন। শিশুকাল থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিলো। পিতার ধ্রুপদ ও টপ্পা চর্চা শুনেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী ফুফাতাে ভাই শামসুল হকের কাছেই তিনি সংগীতের তালিম নিতে থাকেন। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সংগীত অনুষ্ঠানে গান শােনা এবং সংগীত পরিবেশনই ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। সংগীতের সুরের টানে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় যান। প্রখ্যাত সংগীত সাধক নুলো গােপাল বাবুর প্রধান শিষ্য- রস বিহারী মল্লিকের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়ালের তালিম নিতে শুরু করেন তিনি। আর্থিক সংকট তাঁর কলকাতার সংগীত শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করে। এ সংকট মােচনের জন্যে তিনি ওয়েলম্যান স্টোরে সেলসম্যানের চাকরি গ্রহণ করেন। পরে তিনি কুষ্টিয়া মিলে চাকরি গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি কুষ্টিয়ায় সংগীতের প্রসারকল্পে একটি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে তিনি মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতেও অনুরূপ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পুনরায় কলকাতায় ছুটে আসেন এবং গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর প্রতিষ্ঠিত সংগীত-ভবনে ভর্তি হন। এখানে তিনি গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর ভাগ্নে শ্ৰী যামিনী গাংগুলীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তামিল নিতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৪২ সালে কলকাতা সংগীত কলাভবন থেকে সম্মানসূচক সার্টিফিকেট লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিন (ছদ্মনামে R. Munshi অর্থাৎ রবীন মুনশী নামে) কলকাতা বেতারে সংগীত পরিবেশনের সূচনা করেন। ১৯৪০ সালে ‘সরল সঙ্গীতসার’ নামে সংগীতগ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন করেন। সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি নামে আরেকটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ও পদ্মাবতী নামে একটি ‘রাগও সৃষ্টি করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বেতারের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েন। ১৯৫৫ সালে তিনি দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন এখানকার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষার জন্য ১৯৬০ সালে তাঁর রচিত ‘প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি গ্রন্থটি টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমােদিত ও প্রকাশিত হয়। অভিনব শতরাগ গ্রন্থটি রচনার জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি ‘দাউদ সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। সংগীত গবেষণার জন্য এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৭ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদকসহ ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স সম্মানে ভূষিত করা হয়। এই খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ অভিনব শতরাগসহ প্রায় সহস্র গীত বন্দেশ রচনা করেছেন। এসব বন্দেশে রয়েছে ধ্রুপ, খেয়াল, লক্ষণগীতি, রাগ দোহা, ঠুমরী। এছাড়া মুনশী রইস উদ্দিন ‘আলম পিয়া’ ছদ্মনামে অসংখ্য রাগভিত্তিক গান সৃষ্টি করে উত্তরসুরীদের জন্য এক স্মরণযােগ্য সুরের ভুবন সৃষ্টিসহ সংগীতজগতের এ গুণী বরেণ্য পুরুষ অসংখ্য শিষ্য ও সংগীতশিল্পী সৃষ্টি করে গেছেন। ওস্তাদ সুরশিল্পী মুনশী রইস উদ্দিন ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। এ গুণী শিল্পীকে আজিমপুরের নতুন গােরস্থানে সমাহিত করা হয়।

মন্তব্য: