1. লোক

মাগুরা সদরের লোকজ শিল্পী ও অনুষ্ঠান

মোঃ আইয়ুব হোসেন মন্টুঃ সুচনা সংগীত একাডেমী নামে একটি লোকজ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হাজীপুর গ্রামে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মোঃ আইয়ুব হোসেন মন্টু লোকজ বাদ্যযন্ত্র বাঁশি, হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, ঢোল, খোল, জুড়ি বাঁজাতে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। এখানকার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন মানিক্য মজুমদার, বাক্য মজুমদার, মেঘলা মজুমদার, সংগীতা মোহন বিশ্বাস, প্রবীন কুমার বিশ্বাস প্রমুখ।  

দবীর ফকির- পশ্চিম বাড়িয়ালায় জন্মগ্রহন করেন। নিজে গানের দল তৈরী করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লোকজ গান গেয়ে বেড়াতেন। গ্রাম ও ঘর সংসার ছেড়ে তিনি আশ্রয় লালন শাহের মাজারে। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং লালন শাহের মাজারের পাশে তার কবর রয়েছে।

শুকুমার জোয়ার্দারঃ লোকজ গানের শিল্পী। গ্রাম, কান্দা বাঁশকোঠা, মাগুরা।

বাউল কবি ছবদার সাই- বুকে লালনগীতি লালনকারী শিল্পী বাউল কবি ছবদার সাই বেলনগর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯ মে ২০০০ সালে। বেলনগরেই তার আখড়া ও মাজার রয়েছে। এখানে প্রতি বছর  জৈষ্ঠ্য মাসের ৫ তারিখে লালন গীতির আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লালনভক্তরা এখানে জমায়েত হয়। 

বসির উদ্দিন মোল্যা (বারাশিয়া)ঃ বয়াতি বসির উদ্দিন মোল্লা বগিয়া ইউনিয়নের বারাশিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তিনি মূলত ধূয়ো গান লিখতেন। গাইতেন অন্যান্য লোকজ গান।  জীবদ্দশায় তার বাড়িতে প্রতি আরবি সনের ১০ মর্হরম তারিখে ধূয়া গানের আসর বসতো। এই আসরে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পীদের আগমন ঘটতো। বয়াতি বসির উদ্দিন মোল্যা তাঁর গ্রামসহ অন্যান্য গ্রামেও অনেক শিষ্য রেখে গেছেন। এসব শিষ্যদের মুখেই তার রচিত গানগুলো শোনা যায়।   

বাউল নিজাম উদ্দিন লালনীঃ  বয়াতি বসির উদ্দিন মোল্যার পুত্র। তিনি মূলত লালন গানের সাধক। তিনি লিখেছেন বাউল গান, দেহতত্ত¡ গান। তিনি বাংলদেশ টেলিভিশন এর পালাগান ও আদি লালনগীতির তালিকাভুক্ত শিল্পী। তিনি লালন একাডেমীসহ বিভিন্ন লোকজ সংগঠনের সদস্য। নিজে গান রচনা করেন কিন্তু লেখা হয়না একটি গানও। মঞ্চেই গান রচনা     করেন, মঞ্চেই গেয়ে থাকেন। কিছুদিন পর পুরনো হলে গানগুলো হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় গান গেয়েছেন। তাছাড়া ভারতের নদীয়াসহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলায় গান গেয়েছেন। নিজাম উদ্দিনের দুই স্ত্রী আনোয়ারা     বেগম ও শাহিদা বেগম। চার ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।

মোঃ আবুল কালাম মোল্যাঃ বয়াতি বসির উদ্দিন মোল্যার শিষ্য বয়াতি। এছাড়া কালাম মোল্যা দরি মাগুরার সুরেন বিশ্বাস (দরি মাগুরা), আব্দুল জব্বার (করচাডাঙ্গা), উজির বিশ্বাস (পারলা) ও সোনাউল্লার (বারাশিয়া) রচিত ধূয়া গান গেয়ে থাকেন। নিজেও রচনা করেছেন বিভিন্ন ধূয়া গান।

সুধীর রায়ঃ বেঙ্গা গ্রামের সুধীর বয়াতী নিজে জারি গান রচনা করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেসব গান পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষকে আনন্দ দিয়ে থাকেন। সুধীর বয়াতী সমাজ সংস্কারমূলক জারিগানই বেশি রচনা করেন।   

অশ্বিনী সরকারঃ  মাগুরা সদরের সত্যপুর গ্রামের অশ্বিনী সরকার নিজে জারি গান রচনা করেন এবং জেলার বিভিন্ন মঞ্চে সেসব গান পরিবেশন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অনেক গান রচনা করে মানুষকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে যথেষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেছেন। রাজনীতিসহ সহ সমসাময়িক জীবন যাপন, কৃষি, দৈনন্দিন সমস্যার উপর জারি গান রচনা করেছেন।

তরিকুল ইসলামঃ  মাগুরা সদরের মঘী  গ্রামের তরিকুল ইসলাম মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চলে ভাব গান গেয়ে থাকেন। 

ওলিয়ার রহমানঃ  বড়খড়ি গ্রামের  ওলিয়ার রহমানও ভাব গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দান করেন। 

বাউল আঃ লতিফ Ñ জারীগানের শিল্পী বাউল আঃ লতিফ ১৯৪০ সালে জগদল ইউনিয়নের খর্দ্দ ছনপুর গামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম জয়নাল বিশ্বাস। আঃ লতিফ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। বিভিন্ন স্থানে জারিগানের আসরে মানুষকে মাতিয়ে রাখতেন সারারাত। সম্মাননা স্বরুপ বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন সরকারী অনুদান। এখন এই শিল্পী ও বয়াতী ৮২ বছর বয়সে গানের ভুবন ছেড়ে অবসর জীবন যাপন করছেন। তার রচিত গানসমূহের স্বীকৃতি আজও মেলেনি কোনভাবে। শুধু দর্শকশ্রোতাদের মনরঞ্জনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে গানগুলো। এই শিল্পীর বাবা জয়নাল বিশ্বাসও ধুয়োগান ও জারিগান রচনা করেছেন। বাবার হাত ধরেই আঃ লতিফের শিল্পীজীবন শুরু হয়।

বাউল ছমির মোল্যাঃ বাউল ছমির মোল্লা মাগুরা সদর উপজেলার বুজরুক শ্রীকুন্ডি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বর্তমান বয়স ৪৮ বছর। ছমির বাউল হিসাবেই মাগুরাসহ দেশব্যাপী পরিচিত। তার পিতার নাম আব্দুর রাজ্জাক। ছোট বেলাতেই মাকে হারান। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ৬ বছর বয়স থেকে সংগীত জগতে বিচরণ। মাগুরা ললিতকলা একাডেমীতে ভোলাবাবুর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তারপর তিনি জগদল ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের কান্তিরাম বিশ্বাস এবং শত্রæজিৎপুরের হাজারী বিশ্বাসের কাছে সংগীতের দীক্ষা নিয়েছেন।  প্রথম জীবনে তিনি যাত্রা, থিয়েটার, নাটক, জারিগান, গাজীর গান করেছেন গ্রামে গ্রামে। বর্তমানে তিনি লালনগীতির ধারক ও বাহক। বিটিভিতে লালনগীতির নিয়মিত শিল্পী। একতারা ও বায়া নিয়ে গান গেয়ে বেড়ান গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায়। গান নিয়ে ভ্রমন করেছেন আলজেরিয়া, কাতার ও মরক্কো। বিভিন্ন অঞ্চলে তার সংগী শিল্পী ফকরুদ্দিন বয়াতী, বিমল বয়াতী, শুকুমার জোয়ার্দার ও বাউল নিজাম উদ্দিন লালনী। ছমির বাউল ও সালেহা বেগম দম্পতির দুই ছেলে, দুই মেয়ে। 

শুকুর আল মামুন (করচাডাঙ্গা)- লোকজ গানের শিল্পী শুকুর আল মামুন মাগুরা সদর উপজেলার চাউলিয়া ইউনিয়নের করচাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম মৃত আবুল কাশেম। মাতার নাম মৃত জাহানারা বেগম। বড় ভাই হাফিজুর রহমানের কাছে তার সংগীতের হাতে খড়ি। তার রচিত অসংখ্য পল্লীগীতি, ভাবগান, দেহতত্ত¡, মুর্শিদি, মারফতি, আঞ্চলিক, গুরুপদি, শিষ্যপদি প্রভৃতি গান রয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত গীতিকার।  ২৫ বছর বয়স থেকে গান লেখেন এবং গান গেয়ে থাকেন। প্রথম জীবনে যাত্রাপালায়ও অংশগ্রহন করেছেন। শুকুর আল মামুন ও জোহরা খাতুন দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। 

আশুতোষ সরকার ঃ মাগুরা সদরের বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের চেঙ্গারডাঙা গ্রামের আশুতোষ সরকার ১ বৈশাখ ১৩৮০ বাংলা সনে জন্মগ্রহণ করেন।  কবিগান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেন মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কবিগান পরিবেশনে তিনি কর্নেট, কাশি, করতাল (জুড়ি), ঢোল, হারমোনিয়াম, দোতরা ও বেহালা ব্যবহার করেন। সাকার-নিরাকার, গুরু-শিষ্য, ধর্ম-অধর্ম, ধর্ম-বিজ্ঞান, ভক্ত-ভগবান, কাম-প্রেম, জ্ঞানবাদ, ভক্তিবাদ প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিভিন্ন শিল্পীর সাথে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করেন। কবিগানের বন্দনা ঈশ্বরমুখী। শিল্পী আশুতোষ সরকারের দোহারগন হলেন অশোক বিশ্বাস (টিকারবিলা)Ñ হারমোনিয়াম, শংকর বিশ্বাস (কণ্ঠ)Ñচেঙ্গারডাঙ্গা, মনিন্দ্রনাথ বিশ্বাস (কণ্ঠ)Ñ টিকারবিলা, মন্টু বিশ্বাস (ঢোল)Ñ কাঠিগ্রাম। আশুতোষ বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলায় গান করেছেন। ভারতের নদীয়া জেলার কুমারপুর গ্রামেও গান গেয়েছেন। আশুতোশ এর প্রতিযোগি শিল্পীরা হলেন * নিশিকান্ত সরকার, মাগুরা * অনাদী সরকার, মোল্লারহাট , বাগেরহাট * নারায়ন সরকার, ডুটকুরা, বাগেরহাট * নিতাই সরকার, ফরিদপুর * গৌর সরকার, টিকারবিলা, মাগুরা * প্রশান্ত সরকার, মাদারীপুর * স্বপন সরকার, কোটালিপাড়া * রবি সরকার, বাগেরহাট * গোরাচাঁদ, মাগুরা * তিমির সরকার, বাগেরহাট * সন্ধ্যা রাণী, বাগেরহাট * মিরা সরকার, বাগেরহাট * শ্যামল সরকার, বাগেরহাট এবং অমল সরকার, মাদারীপুর। মাগুরা অঞ্চলের কবিগানের ঢং ভাটিয়ালী, বাউল, বৈঠকী, ভক্তিমূলক ইত্যাদি।

পরিমল অধিকারীঃ মাগুরা সদরের বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের রামদেরগাতি গ্রামের পরিমল অধিকারী মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কবিগান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেন।   

আলমগীর বয়াতীঃ মাগুরা সদরের বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের চর বিজয়খালী গ্রামের আলমগীর হোসেন জারিগান গেয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন বিভিন্ন এলাকায়। গোলাম ছরোয়ার ও নীলিমা খাতুন এর পুত্র আলমগীর হোসেন (৩৭) পনের বছর যাবৎ জারী গান পরিবেশন করেন। নিজেও লেখেন জারীগান বিচার গান ও ভাব বিচ্ছেদ গান। আলমগীর বয়াতী গান শিখেছেন শালিখা উপজেলাধীন সোনাকুড় গ্রামের প্রয়াত জামাল উদ্দীন বয়াতীর কাছে। তারপর থেকে তিনি সোহরাব-রোস্তম, আলী-হানিফা (বাপ-বেটার লড়াই), হাসানের বিষপান, কাসেম শহীদ, হোসেন শহীদ, কোরবানী, জয়নাল উদ্ধার, সুরতলালের বিয়ে, রাজেশ্বরীর বিয়ে, জান চুরি, মোসলেমের পুত্রবধ, হোসেন সমাধী, এজিদ বধ পর্ব প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক জারী গান পরিবেশন করেছেন মাগুরাসহ নারায়নগঞ্জ, কুমিল্লা, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরেজপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, নড়াইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর প্রর্ভতি জেলায়। তিনি নারী-পুরুষ, শরিয়ত-মারফত, হিন্দু-মুসলমান, আদম-শয়তান, হাসর-কেয়ামত, নবুয়ত-বেলায়েত, নূর-কার, জীব-পরম, রাধা-কৃষ্ণ, গুরু-শিষ্য, কাম-প্রেম প্রভৃতি বিষয়ে জারী গান ও বিচারগানে প্রতিদ্ব›িদ্বতার সম্মুখীন হয়েছেন বিভিন্ন জেলার লোক শিল্পীর সাথে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন সাইফুল ইসলাম (নড়াইল), কামরুল হাসান (নড়াইল), রিণা পারভীন (খুলনা), বেবী খানম (খূলনা), কাজল রেখা (বরিশাল), নিলুফা ইয়াসমীন (বরিশাল), রশিদা পারভীন (খুলনা) প্রমুখ। স্ত্রী শুকুরন নেছা ও এক ছেলে-এক মেয়ে নিয়ে নিজ গ্রামেই বাস করছেন। আলমগীর বয়াতীর সহশিল্পীরা হলেন-

মাস্টার নায়েব আলী (আমুড়িয়া, মাগুরা) – হারমোনিয়াম, দোহার

চঞ্চল মোল্যা (শালিখা, মাগুরা) – ঢোল

শ্যামল বিশ্বাস (ভাঙ্গুড়া, মাগুরা)- বাঁশি

আবুল বাশার (মিঠাপুর, নড়াইল)- মন্দিরা, দোহার

আব্দুল ওয়াহাব (পুলুম, শালিখা, মাগুরা)- দোহার

হাসেম আলী (বুলুগ্রাম, মাগুরা)- দোহার 

গোলাম মওলাঃ মাগুরা সদরের বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের ডহর সিংহড়া ভাবগান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেন। 

নিশিকান্ত- সরকার ঃ গোপালগ্রাম এর নিশিকান্ত সরকার কবিগান এর শিল্পী হিসাবে বেশ পরিচিত।

অষ্টকগানঃ অষ্টক গান হলো শিব-দূর্গা গীত। চৈত্র মাসে পাড়ায় দেল নিয়ে এ গান গাওয়া হয়। গায়ক ও গায়িকা উভয়ই থাকে এই গানে। শিব-দূর্গা, রাধা-কৃষ্ণের নিলন-বিরহের মাধূর্যময় সংগীত হলো অষ্টক গান। এই গানের সাথে সংশ্লিষ্ট পূজাকে চড়ক পূজা বা দেল পূজা বলা হয়। আঠারোখদার ইউনিয়নের আড়াইশত, মালন্দ, মৃগীডাঙ্গা, মাধবপুর ও বাঁশকোঠা গ্রামে অষ্টক গানের প্রচলন রয়েছে। রাঘবদাইড় ইউনিয়নের বেঙ্গা গ্রামে অষ্টক গানের প্রচলন রয়েছে। বেঙ্গা গ্রামের শ্রী গৃধর বিশ্বাস এর নেতেৃত্বে অষ্টক গানের একটি দল রয়েছে। আসবা, উত্তরধর্মসীমা, কুল্লিয়া ও কুচিয়ামোড়া গ্রামে অষ্টকগান হয় অনুষ্ঠিত হয়। 

হলুই গানঃ মাগুরা জেলাব্যাপী হলুই গানের প্রচলন রয়েছে। হলুই গান গাওয়া হয় পৌষ মাসে। হলুই গান হলো গাজী কালু সম্পর্কিত গান। এই গানের সংশ্লিষ্ট পূজাকে বাস্তু পূজা বলা হয়। বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল-ডাউল সংগ্রহ করে গ্রামের সবাই মিলে খিচুড়ি অথবা শিরনি রান্না করে খওয়া হয়।  

ভাবগানঃ  মাগুরা সদর উপজেলাধীন হাজীপুর গ্রামে পূর্বকালে ভাবগান হলেও অস্থির পরিবেশ, প্রমোদ মানষিকতা ও পৃষ্টপোষকতার অভাবে উৎসবগুলো এখন এলাকাবাসীর জন্য শুধুই অতীত স্মৃতি।  আড়াইশত ও মালন্দ গ্রামে ভাবগানের আসর বসে শীত মৌসুমে। পুখরিয়া গ্রামে বিচার গুান ও ভাবগানের আসর বসে শীত মৌসুমে। ছনপুর ও খর্দ্দছনপুর ভাবগান অনুষ্ঠিত হয় শীত মৌসুমে। চাঁদপুর গ্রামে লাঠিখেলা ও ভাবগান অনুষ্ঠিত হয়। আশ্বিন মাসের প্রথম দিনগত রাতে ভাবগান অনুষ্ঠিত হয়। কার্ত্তিক মাসের প্রথম দিন লঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। বুজরুক শ্রীকুন্ডির বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে লাঠিখেলা ও বিচার গান অনুষ্ঠিত হয়। ভাবগানের আয়োজন করা হয় বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের ডহর সিংহড়া গ্রামে। আমুড়িয়া গ্রামে তেশারত বয়াতী নামে এক শিল্পী ছিলেন যিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাবগান গাইতেন। ২০১০ সালে এই শিল্পীর মৃত্যু হয়। বর্তমানে আমুড়িয়া গ্রামের নায়েব বয়াতী ভাবগানের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।  

কবিগানঃ প্রতি শীত মৌসুমে টেঙ্গাখালী বাজারে কবি গানের আসরে মেতে ওঠে এলাকার আবাল বৃদ্ধ বনিতা। খুব বড় আঙ্গিকে শৈলডুবি আশ্রমের সামনে প্রতিবছর কার্তিক মাসের ২৫ ও ২৬ তারিখে কবিগানের আয়োজন করা হয়।   কবিগানের আসর বসে আলোকদিয়া গ্রামে। সিরিজদিয়া গ্রামে কবিগান অনুষ্ঠিত হয়। কবিগানের আসর বসে বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের চেঙ্গারডাঙা, দীঘলকান্দি ও পুটিয়া গ্রামে। কবিগানের আয়োজন করা হয় কুচিয়ামোড়া গ্রামে। কবিগানের আসর বসানো হয় ফতেরহাট গ্রামের কবিখোলা নামক স্থানে। গোপালগ্রামের নিশিকান্ত সরকার (বাবা-নবদ্বীপ সরকার) কবিগানের শিল্পী ও লেখক।

জারীগানঃ জারীগানের আসর বসে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন সময়ে। উল্লেখযোগ্য জারীগানের শিল্পীরা হলেন শ্রী অশ্বিনী কুমার (সত্যপুর), গোলাম হোসেন (মঘি), আবু তালেব (মঘী), বাটুল বিশ্বাস, দুলাল বিশ্বাস প্রমুখ। জগদল ইউনিয়েনের দমদমা গ্রামেও জারীগান এর আসর বসে। ছনপুর ও খর্দ্দছনপুর গ্রামে জারীগান অনুষ্ঠিত হয় শীত মৌসুমে। জারিগান আগে হতো চাঁদপুর ও ধলহরা গ্রামে কিন্তু এখন আর হয় না। জারীগানের আসর বসে বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের বিজয়খালী ও ডহর সিংহড়া গ্রামে। এছাড়াও জারীগানের আসর বসে আমুড়িয়া, কুল্লিয়া ও বড় শলই গ্রামে। জারীগানের আসর বসে গোয়ালবাথান গ্রামে শীত মৌসুমে। বিজয়খালী গ্রামের আলমগীর বয়াতী জারীগানের শিল্পী হিসাবে এলাকায় বেশ সুনাম রয়েছে।

গাজীর গানঃ পীর গাজী-কালুর স্মরণে ভক্তিমূলক গানই গাজীর গান হিসাবে খ্যাত। গাজী গানের শিল্পী সিরাজ বয়াতীর সাথে কথা বলে গাজীর গান বিষয়ে পাওয়া যায় অনেক তথ্য। তিনি ৩৬ বছর যাবৎ মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় গাজীর গান গেয়ে থাকেন। তার দলে অভিনয় করেন ১৪ জন। অন্যান্যরা হলেন, মোঃ খবির মৃধা, ইউছুফ,লালচান, আশরাফ প্রমুখ। তিনি বলেন, গাজীর নামে ভক্তি করলে মুক্তি মেলে। গাজীর জীবন বিষয়ে ভক্তদের কাছে আলোচনা করার নিয়ম। কিন্তু গাজীর নামে গান গাইতে হবে এমন কোন নিয়ম নেই। এটি একটি লোকসংস্কার বা লোকবিশ্বাস। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রঙঢঙের পোশাক পরিধান করে তাদেরকে আকৃষ্ট করা, এই কাজটি শিল্পীরা করেন জীবিকার তাগিদে। অন্যরা রঙঢঙের পোশাক পরিধান করলেও গাজী চরিত্র (বয়াতী নিজে) সাধারণত পাঞ্জাবী ও পাঞ্জাবী পরতে দেখা যায়। গাজীর গানে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয় হারমোনিয়াম, ক্যাসিও, জুড়ি, ঢোল ও বাঁশি। 

সিরাজ বয়াতী বলেন, গাজীর গানের সাতটি পালা আছে। সেগুলো নিম্নরূপÑ

তাইজেল বাদশা————-চরিত্র ১৪টি

দিদার বাদশা —————চরিত্র ০৯টি

আততাফ মোহাততাফ——- চরিত্র ১৩টি

কহজাল বাদশা————–চরিত্র ১৪টি

জামাল বাদশা—————চরিত্র ১৪টি

বিয়ের পালা —————-চরিত্র ১৯টি

শ্রবন ছলেমান—————চরিত্র ১৮ টি

তথ্যঃ সিরাজ বয়াতী, পিতাঃ গফুর ফকির, বয়সÑ ৪৯ বছর, গ্রামঃ দাতিয়াদহ, উপজেলাঃ মহম্মদপুর, জেলাঃ মাগুরা।

বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তির আশায় ও নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান লাভের আশায় গাজীর গানে মানত করে। অতঃপর কোনভাবে রোগমুক্তি হলে কিংবা সন্তান লাভ হলে গাজীর গানের আসর বসানো হয়। কছুন্দি ইউনিয়নের গ্রামসমূহে কুসংস্কারকে আশ্রয় করে গাজীর গানের মানত করে বিভিন্ন গ্রামে গাজীর গানের আসর বসায় এলাকার লোকজন বিভিন্ন সমস্যা রোগমুক্তির আশায়। বগিয়া ইউনিয়নের বরই ও বারাশিয়া গ্রামে গাজীর গানের প্রচলন প্রচুর পরিমানে দেখা যায়। রাঘবদাইড় ইউনিয়নের বেরোইল গ্রামে গাজীর গানের তিনটি দল রয়েছে। আজিজ ফকিরের দল, কওসার বিশ্বাসের দল ও বক্কার শেখ এর দল। এছাড়া মালঞ্চি গ্রামে সিরফান মোল্যার নেতৃত্বে গাজীর গানের একটি দল রয়েছে। দমদমা গ্রামে গাজীর গান অনুষ্ঠিত হয়। জগদল গ্রামে বৈয়াতী বাকিয়ার রহমানের নেতৃত্বে গাজীর গান অনুষ্ঠিত হয়। চাউলিয়া ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে গাজীর গান এর আসর বসে। তবে চাঁদপুর গ্রামে এই গানের রেওয়াজ বেশী দেখা যায়। বুজরুক শ্রীকুন্ডি গ্রামের নুর ইসলাম বয়াতী গ্রামের অন্যান্যকে সাথে নিয়ে গাজীর গানের একটি দল পরিচালনা করেন। চাউলিয়া ইউনিয়নে গাজীর গানের প্রচলন রয়েছে। ধর্মদাহ গ্রামের আকবর বয়াতীর নেতৃত্বে একটি গাজীর গানের দল রয়েছে। বাটিকাবাড়ি, আমুড়িয়া ও কুল্লিয়া গ্রামে গাজীর গানের প্রচলন রয়েছে। 

পুঁথি পাঠঃ মাগুরা সদরের মঘী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে পুঁথি পাঠে মানুষের মাঝে ছিল বেশ আগ্রহ। উল্লেখযোগ্য পুঁথি শিল্পী হলেন  মঘী গ্রামের বিশারত মোল্যা ও হাশেম মোল্যা। 

যাত্রা পালাঃ একসময় মাগুরার বিভিন্ন স্থানে যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল। মঘী ইউনিয়নে একটি যাত্রাদল ছিল যারা মাগুরা জেলাসহ অন্যান্য জেলায় অভিনয় করতো। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুহ হয়ে পড়েছেন এলাকার অধিকাংশ যাত্রাশিল্পী। বর্তমান প্রজন্ম ধারাটির কিছুটা অব্যাহত রাখলৌ পূর্বের ন্যায় আনন্দ আর জৌলুস নেই। উল্লেখযোগ্য যাত্রাশিল্পীরা যারা আনন্দে মাতিয়ে তুলতেন বিভিন্ন অঞ্চল তারা হলেন কানাইলাল বসু, আবু তেছেম মোল্যা, সিরাজ মোল্যা, বদরুদ্দিন মোল্যা, মুজিবর শেখ, আয়েন উদ্দিন মোল্যা, তুরফান মোল্যা, ডাঃ ওসমান গনি, জোয়াদ আলী বিশ্বাস প্রমুখ। বর্তমানে মঘী যুব একতা যাত্রাগোষ্ঠী নামে একটি দল বিভিন্ন স্থানে যাত্রাপালায় অংশগ্রহন করে। এই দলের অভিনিত যাত্রাপালা যথাক্রমে জামাল ঝুমকার প্রেম, রাজার ছেলে পন্ডিতের মেয়ে, জুতাপালিশ, প্রেম হলো কাগজের ময়লা। এই যাত্রাপালাগুলোর রচয়িতা মঘী গ্রামের বাদসা মোল্লা।

এছাড়া, আমুড়িয়া ও কুচিয়ামোড়া গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়।  মহামায়া যাত্রাদল নামে একটি যাত্রাগোষ্ঠি সারা  বাংলাদেশে যাত্রাভিনয় করতো। এলাকার কুচিয়ামোড়া গ্রামের বিশিষ্ট যাত্রাসংগঠক মৃত অমরেশ বাবুর স্ত্রী যাত্রাশিল্পী মহামায়ার নামে যাত্রাদলটি গঠন করেন। এই দলের অন্যান্য শিল্পীরা হলেন কাজল বিশ্বাস, অরবিন্দু বালা, বিপুল মন্ডল, আবুল কালাম, হাবিবুর রহমান প্রমুখ। 

কীর্ত্তন গানের প্রতিযোগীতাঃ হাজীপুর গ্রামের রাজবংশী স¤প্রদায় একদা কীর্ত্তন প্রতিযোগীতার আয়োজন করতো। বিভিন্ন এলাকার কীর্ত্তণ দল এই প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করতো।

সুচনা সংগীত একাডেমী নামে একটি লোকজ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হাজীপুর গ্রামে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক গ্রামের অধিবাসি এ্যাডভোকেট আবু শ্যাম সাবান। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মোঃ আইয়ুব হোসেন মন্টু লোকজ বাদ্যযন্ত্র, হারমোনিয়াম, ডুগি-তবলা, ঢোল, খোল, জুড়ি বাঁজাতে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত। এখানকার উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন মানিক্য মজুমদার, বাক্য মজুমদার, মেঘলা মজুমদার, সংগীতা মোহন বিশ্বাস, প্রবীন কুমার বিশ্বাস প্রমুখ।  

তথ্যপ্রদানকারীঃ 

লিয়াকত আলী মুন্সী, চেয়ারম্যান, গোপালগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ 

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, চেয়ারম্যান, কুচিয়ামোড়া ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা 

খন্দকার মহব্বত আলী,  চেয়ারম্যান, বেরোইল পলিতা ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা

স্বপন ভট্রাচার্য, পুরোহিত, শত্রæজিৎপুর শ্মশান আশ্রম, মদনমোহন মন্দির ও পঞ্চমুন্ডের কালী বাড়ি মন্দির

মোঃ.কেছমত আলী ও মোঃ ছেকেন্দার আলী, সদস্য চাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ অলিয়ার রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জগদল ইউনিয়ন পরিষদ ও গোলাম নবী কাজল (আজমপুর)

আঃ লতিফ বিশ্বাস চেয়ারম্যান, মঘী ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ বকুল মুন্সী (৬০), দক্ষিণ মির্জাপুর, গ্রামপুলিশ

মোঃ রেজাউল করিম, প্রাক্তন ইউপি মেম্বর, হাজরাপুর ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ খবির আহমেদ, সচিব, কচুন্দি ইউনিয়ন পরিষদ

প্রফেসর মুন্সি আজীজুল হক (অব), হাজীপুর, মাগুরা

মন্তব্য: