1. স্মরণীয় বরণীয়

শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন (১৮৯১-১৯৬২)

শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ১৮৯১ সালের এপ্রিল মাসে’ মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন বুনাগাতি ইউনিয়নের ঘোষগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ দেরাজতুল্লাহ। ১৯০৯ সালে ১৮ বছর বয়সে কবি তাঁর পিতাকে হারান। দু’ভাইয়ের মধ্যে শেখ হবিবর রহমান ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তাঁর একটি বোনও ছিল। কবি শেখ হবিবর রহমান মাগুরা নিবাসী জনাব খন্দকার হাতেম আলীর কন্যা আশরাফুন্নেসার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

কবির শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজগ্রামের পাঠশালায়। পরবর্তীতে পুলুম নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উচ্চ প্রাথমিক পাঠ শেষ হওয়ার পরবর্তীতে তিনি ১৯০০ সালে খুলনার পয়গ্রাম কসবায় গমন করেন এবং পয়গ্রাম কসবা মাইনর স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখানে দুই বছরকাল অবস্থান করার পর পয়গ্রাম অনতিদূরে দক্ষিণ ডিঙ্গি (বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি) গ্রামের নওয়াদালী পল্লীতে এবং দামোদরে ৭/৮ বছর কাল অবস্থানকালে কখনো স্কুলে, কখনো মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। ফুলতলা মাদ্রাসায় এবং হাইস্কুলে পর্যায়ক্রমে পড়াকালীন তেমন মনাযােগী হতে পারেননি। কবিতা লেখার নেশা সে সময় তাঁকে পেয়ে বসে। ফলে পড়ালেখার বিঘ্ন ঘটে এবং এক পর্যায়ে তিনি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে পাইকগাছা উপজেলার সাহাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে চাকরি গ্রহণ করেন ১৯০৫ সালের দিকে। দু’বছর এভাবে অতিক্রম করার পর তিনি ১৯০৭ সালে ফুলতলা হাইস্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১০ সালে উক্ত হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯০৯ সালে পিতৃ বিয়োগের কারণে তিনি চরম আর্থিক সংকটে পড়েন।  তিনি সিটি কলেজ থেকে ১৯১২ সালে আই.এ পাস করেন। ১৯১৪ সালে তিনি বিএ পরীক্ষা দেন এবং অবসরে সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’র সহকারী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বিএ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সমাপ্তি ঘটে। এরপর তিনি যশার জেলা স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতায় ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে এল.টি (Licentious teacher) প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হন এবং এক বছর পর এল.টি পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি বারাসাত গর্ভমেন্ট হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং এখানে বছর খানেক চাকরি করার পর তাকে মক্তব সাব ইন্সপেক্টর হিসাবে খুলনায় বদলী করা হয় ১৯২৪ সালে। ১৯২৭ সালে তিনি খুলনা থেকে হুগলী ব্রাঞ্জ স্কুলে বদলী হন এবং সেখানে তিনি তিনবছর চাকরি করেন। ১৯৩০ সালে বারাকপুর গভঃ হাইস্কুলে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে এই স্কুলের সহকারী শিক্ষকের পদে থাকাকালীন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি খুলনা চলে আসেন এবং ১৯৫১ সালে খুলনা করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসাবে যােগদান করেন এবং ১৯৬০ সালে তাঁর এ অতিরিক্ত কর্মজীবন থেকে দ্বিতীয়বারের মত অবসর গ্রহণ করেন। শেখ হবিবর রহমান দুই দফায় (১৯১৪-১৯৪৪ এবং ১৯৫১-১৯৬০) প্রায় ৪০ বছর কাল শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি নিরলসভাবে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। শেখ হবিবর রহমান ১৯৬২ সালে ইন্তেকাল করেন। 

হাইস্কুলের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই শেখ হবিবর রহমান সাহিত্য সাধনা শুরু করেন। ১৯০১ সালে খুলনা পয়গ্রাম কসবায় মাইনর স্কুলে অধ্যয়নকালে বাংলার খ্যাতিমান সমাজ সংস্কারক এবং বাগ্মী মুনশী মােহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সাহেবের উপস্থিতিতে এক ধর্মসভায় তিনি দু’টি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। কবিতা শুনে মুনশী মেহেরুল্লাহ সাহেব খুবই মুগ্ধ হন এবং শেখ হবিবর রহমানকে ‘শিশুকবি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল দশ (১০) বছর মাত্র। তখন থেকেই তার কবিত্বের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে তিনি শের সংহার কাব্যশিরোনামে ২৮৬ পৃষ্ঠার একটি বড় পান্ডুলিপি রচনা করেন। এটি শের আফগান জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রণয়ঘটিত কাহিনী নিয়ে লিখিত। তারপর রচনা করেন মহা প্রলয় কাব্য। এরপর ১৯০৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে তার বিখ্যাত ‘কোহিনুর’ কাব্য রচনা সমাপ্ত করেন। কবির প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ৩০টি।  প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ পারিজাত এটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশ ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯১২ সালে। গ্রন্থটি প্রকাশের পর সম-সাময়িক পত্র- পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার ও প্রশংসা পান। সাপ্তাহিক মােহাম্মদী, মাসিক হাকিম, সঞ্জীবনী, দৈনিক চন্দ্রিকা, প্রভাকর, মােসলেম হিতৈষী, সুপ্রভাত কলিকাতা থেকে প্রকাশিত “The Bengali’ পত্রিকাসহ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় কাব্যগ্রন্থটির উচ্চকিত প্রশংসা সূচিত হয়। আবে হায়াত (গজল গ্রন্থ) প্রথম প্রকাশ: ১৯১৪। প্রখ্যাত পারস্য কবি হাফিজ, শামসুত তবয়েজ, হযরত খাজা মঈন উদ্দীন চিশতী, শেখ সাদী, আমীর খসরু প্রমুখ কবিদের বিখ্যাত গজলের অনুবাদ এবং স্বরচিত কয়েকটি গজলসহ সর্বমােট ৪২টি গীতিকবিতার সংকলন আবে হায়াত। বাঁশরী: কাব্যগ্রন্থ।  প্রথম এবং একমাত্র প্রকাশ : ১ সেপ্টেম্বর, ১৯১৭। মােট ১২০টি কবিতার সংকলন ‘বাঁশরী। কোহিনুর কাব্য প্রথম প্রকাশ: ১৯১৯, সর্বমোট ন’টি পর্বে, ২৬৮৯ লাইনের এই মহাকাব্যে সৃষ্টির পূর্ব হতে হযরত আদমের পৃথিবীতে আগমন পর্যন্ত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে।  কবি শেখ হবিবর রহমানের সুবর্ণ সময় হলা যশোর অবস্থানের সুদীর্ঘ নয় বছর। খুলনা অবস্থানকালে স্বীয় উদ্যোগে বাংলা ১৩১৮ সালে ‘যশাের-খুলনা সিদ্দিকীয়া সাহিত্য সমিতি’ নামে একটি সংগঠন করেন। সমিতির কলকাতা শাখা হতে মলয়া ও যশোর শাখা থেকে ‘শুকতারা’ নামে দু’খানা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতো। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবদান রয়েছে। এ সময়ে কবির পরীরকাহিনী, নিয়ামত, হাসির গল্প, বাঁশরী ভারত সম্রাট বাবর; গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। কবির উল্লেখযােগ্য রচিত গ্রন্থগুলাের মধ্যে: আবে হায়াত

(১৯১৪); বাঁশরী(১৯১৭); কোহিনুর (১৯১৯); সাদীর কালাম (অনুবাদ- ১৯২৬); গুলিস্তার (বঙ্গানুবাদ- ১৯৩৩); বুস্তার (বঙ্গানুবাদ- ১৯৩০); কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৯৩৪); দারুল মুখতার (১৯২৪); সুন্দরবনের ভ্রমণ কাহিনী (১৯২৬); আমার সাহিত্যজীবন (১৯২৭); চেতনা (১৯১৫); মােল্লা বাকাউল্লা (১৯৪৭); আলমগীর (১৯১৯); ছেলেদের হয়রত মুসা (আ:) (১৯৩৪); ছােটদের গল্প (১৯৩৫); পরীজাদা গুলবাহার (১৯১৯); জেনপরী (১৯২৮); ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ (১৯৪৩); শয়তানের সভা (১৯৫৩); ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম (১৯৪৯); মরণের পরে (স্পিরিচুয়ালিজম) (১৯৫৫); সংক্ষেপে বিষাদ সিন্ধু (১৯৩৭); মাল করে ইসলাম প্রচার (১৯২৪); সত্যের সন্ধানে ইত্যাদি।

কবির অনেকগুলো অ-প্রকাশিত গ্রন্থ: আজও মনে পড়ে ঢাকা রেডিও থেকে প্রচারিত সাহিত্য রস মধুর বারােটি প্রাচীন কাহিনী। জিন্দাপীর আলমগীর সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীরের চরিত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। এতে আওরঙ্গজেবের মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ অধিবাসীদের সাথে সংগ্রামের বিবরণ সন্নিবেশিত হয়েছে। মজার গল্প হাসির গল্পে’র ধরনে লিখিত। নীতি উপদেশ পূর্ণ শতাধিক হাসির গল্প। গোঁড়ামি ও অন্ধ বিশ্বাস খােদার শ্রেষ্ঠদান বিবেক ও বিচার বুদ্ধি উপক্ষো করে দেশের একদল মুসলমান যেভাবে প্রকৃত ইসলাম বিসর্জন দিয়ে ধ্বংসের পথে ছুটে চলছে তার স্বরূপ উদঘাটন করে লিখিত। সর্বত্র কোরানশরীফ ও হাদীসশরীফ থেকে প্রমাণসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। পরলোক প্রসঙ্গে মরণের পরের দ্বিতীয় খণ্ড।  শের সংহার কাব্য  সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নুরুজাহানের প্রেমকাহিনী অবলম্বন অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রায় দুইশত পৃষ্ঠায় এ কাব্য ১৯০৫ সালে কবির ১৪ বৎসর বয়সে লিখিত হয়েছিলো। সত্যের সন্ধানেভাবিবার কথা খোদা প্রাপ্তির সোজা পথ এবং দাদুর দফতর

মৌলবী জনাব জমির উদ্দিন বিদ্যা বিনােদ-এর মধ্যস্থতায় কবির প্রকাশিত পুস্তকগুলো ‘নদীয়া সাহিত্যসভাকে উপহার দেয়ার হয়। নদীয়া সহিত্যসভা কবিকে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধিতে বিভূষিত করেন। পরে নিখিল ভারত সাহিত্য সভা কবিকে দু’টি উপাধি দান করে। ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি কবিকে ফেলাে নির্বাচিত করে এবং সকল গ্রন্থ একত্রে প্রকাশের জন্য স্বত্ব ক্রয় করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি শেখ হবিবর রহমান গ্রন্থাবলী প্রথমখণ্ড প্রকাশ করে।

মন্তব্য: