1. স্মরণীয় বরণীয়

মোহাম্মদ গোলাম হোসেন (১৮৭৩ – ১৯৬৪)

মােহাম্মদ গোলাম হোসেন বাংলা ১২৭৯/১২৮০ সালের ফাল্গুন মাসে, ১৮৭৩/১৮৭৪ সালে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলাধীন জোকা গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কবি মোহাম্মদ গোলাম হোসেন নিজের জন্মতারিখ সম্পর্কে সঠিক কোনো খবর রেখে যাননি। তাঁর আত্মজীবনীতে ১২৭৯/১২৮০ সনের ফাল্গুন মাসের উল্লেখ করেছেন। অবশ্য তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তিনি একটি নির্দিষ্ট তারিখের কথা বলতেন; সে হলো কবি মধুসূদন দত্তর মৃত্যুসন।  এতে ১৮৭৩ সন হয়। তাই ১৮৭৩ সালকেই তাঁর সঠিক জন্মসন ধরে নিলে সবকূল বজায় থাকে। মোহাম্মদ গোলাম হোসেনের পৈত্রিক নিবাস- মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মুনশী আবদুর রহমান। মোহাম্মদ গোলাম হোসেনের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজগ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। পরবর্তীতে তাঁর পিতার কর্মস্থল নড়াইল মহকুমায়। তাঁর পিতা মুনশী আবদুর রহমান সাহেব তৎকালে নড়াইল মহকুমায় চাকরি করতেন। সেখানে মোহাম্মদ গোলাম হোসেন একটি মধ্য ছাত বৃত্তি স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯১ সালে উক্ত স্কুল থেকে তিনি মধ্য ইংরেজি, মধ্য ছাত বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি নড়াইল কলেজিয়েট হাইস্কুলে ভর্তি হন। উক্ত হাইস্কুল থেকে ১৮৯৫ সালে প্রবেশিকা (এট্ট্রান্স) পাস করেন। এরপর সুদূর কলকাতার আলীয়া মাদরাসা কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ তথন প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। ১৮৯৭ সালে তিনি কলকাতার আলীয়া মাদরাসা থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে যখন তিনি উক্ত কলেজে বি এ পড়েন, তখন তাঁর পিতা মুনশী আবদুর রহমান ইন্তেকাল করেন। ফলে তখনকার মতো তাঁকে পড়াশুনা ত্যাগ করতে হয়। এরপর দীর্ঘ ১৮ বছর পর স্থানীয় বি.কে হাইস্কুল (বিনোদপুর বসন্তকুমার বিদ্যালয়) শিক্ষকতাকালীন ১৯১৮ সালে যথারীতি পরীক্ষা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। স্কুলজীবনে তিনি বিখ্যাত কীর্তনিয়া ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন বাংলা বিভাগীয় অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রকে সহপাঠি হিসেবে পেয়েছিলেন এবং কলেজজীবনেও তিনি পেয়েছিলেন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও জগদীশচন্দ্র বসুকে শিক্ষকরূপে। এঁরা উভয়েই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। মোহাম্মদ গোলাম হোসেনের জীবনের একটি বড় ট্রাজেডি ছিল ছাত্রবৃত্তি ক্লাসেই খানদানী মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় এক শরীফ পরিবারে তাঁর পিতা মুনশী আবদুর রহমান সাহেব তাঁকে বিয়ে দিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬/১৭ বছর। বধূর বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। এই বালিকাবধূর জন্যই এবং সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাবেও বটে, তাঁকে অকালেই সংসারজীবনে প্রবেশ করতে হয় এবং অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। প্রথমেই তিনি সরকারি স্কুলসমূহের সহপরিদর্শক হিসাবে চাকরি গ্রহণ করেন। কিছুকাল পরে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজ গ্রাম বালিয়াডাঙ্গার নিকটে একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিনোদপুর বি.কে ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। আজীবন এই বিদ্যালয়ে চাকরি করে ১৯৪৯ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।   অর্থের অভাবে তার লেখা ছাপামো হয়নি। মৃত্যুর বহুকাল পরে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০৪ সালে। এ সময় তিনি সরকারি স্কুলসমূহের সহপরিদর্শকরূপে (Sub Inspector of schools) কর্মরত ছিলেন। তৎকালীন ডেপুটি ইনস্পেষ্টর খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। এই খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ সাহেবের বিশেষ প্রেরণাতেই তিনি সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হন। কবি মোহাম্মদ গোলাম হোসেনের কাব্যরচনা দিয়েই তাঁর সাহিত্যিজীবন শুরু হয় ১৯০৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর বঙ্গ বীরাঙ্গনা নামক ১১৮ পৃষ্ঠার একটি ব্যাঙ্গাত্বক কাব্যগ্রস্থ প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। লেখক বলেছেন, বীরাঙ্গনা বলতে নতুন সভ্যতার আলোকে আলোকিত হৃদয়া কোন সম্প্রদায় বিশেষের মহিলাগণকে প্রধানত লক্ষ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে এখানে সমকালীন বেথুন মহিলা কলেজে শিক্ষাপ্রাপ্তা ব্রাহ্ম মহিলাদিগকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এ কাব্যে স্বাধীন ললনাদের প্রতি ব্যঙ্গ ও স্তুতি আছে। বঙ্গ দেশীয় হিন্দু মুসলমান  তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথম প্রকাশকাল ১৯১০। একটি গদ্যগ্রন্থ। সমকালীন বঙ্গভঙ্গ তথা স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক রচনা। গ্রন্থটিতে হিন্দু ও মুসলমান মানসিকতার তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে এবং এই উভয় সমাজের মিলনের সম্ভাবনা নিয়েও মন্তব্য করা হয়েছে। দিল্লী আগ্রা ভ্রমণ  কবির তৃতীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থের রচনাকাল ১৯১২। গদ্য ও পদ্যে রচিত। কবিতাগুলা ভ্রমণ বিষয়ক। এই হিসেবে এর ঐতিহাসিক মূল্যও অনস্বীকার্য। কবিতাগুলো বাংলাকাব্যের আদর্শে এবং সংস্কৃতানুসারী সাধু বাংলায় রচিত। তাজমহলের বর্ণনায় তাজ দর্শন কবিতাটি আমাদের বাংলাভাষা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। কাব্য যুথিকা (প্রথম খণ্ড)। এ বইটি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। কবিতাটি বাংলাসাহিত্যের বিখ্যাত ছান্দসিক কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের হিমালয়াস্টক কবিতার জবাবস্বরূপ রচিত। তার চট্টগ্রাম সাগরতীরে একাকী কবিতা ১৩৬২ সালের মাঘ মাসের মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়।  নীতি প্রবন্ধ মুকুল নামে সমকালীন মুসলিমসমাজের চাহিদা মোতাবেক একটি পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলেন।  গ্রন্থটি ছাত্রবৃত্তি বিদ্যালয়ের ৫ম ও ৬ষ্ঠ মানের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য লিখিত হয়েছিল(১৯১৮)। বইটি সমকালীন বিদ্যালয়সমূহে বিশেষভাবে আদৃতও হয়েছিল বলে দ্বিতীয় সংস্করণে বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় (১৯২১)। নীতি প্রবন্ধ মুকুল স্কুলপাঠ্য সংকলন হলেও এতে লেখকের নিজের লেখা মৌলিক প্রবন্ধ ও কবিতাও স্থান পেয়েছে। পয়গামে মোহাম্মদী (১৯২১) নামে একটি উর্দুগ্রন্থের অনুবাদও তিনি করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় গ্রন্থ অনুবাদকের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

এছাড়াও কবির কিছু মননশীল প্রবন্ধ ও কবিতা তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।  এতদ্ব্যতীত ইসলাম দর্শনে তাঁর কিছু মূল্যবান প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।  কবির কবিতা প্রকাশের কাল মোটামুটি ১৯০৬-১৯২১ সাল। পরবর্তীকালে একমাত্র কাব্যযুথিকা ১ম খণ্ড প্রকাশিত হয় (১৯৬০)। এই দুই রচনার মাঝখানে ব্যবধান রয়েছে প্রায় চল্লিশ (৪০) বছর। এই দীর্ঘ সময় অজ্ঞাতবাসের কারণে মনে হয়, তাঁর পাঠকগণ তাঁর নাম এক রকম ভুলে যায়।

কবি’র অ-প্রকাশিত রচনাবলী : হজরত মোহাম্মদ (ছঃ আঃ) এর জীবনী (কাব্য) (১ম ও ২য় খণ্ড); পাকিস্তান গাথা ইসলামী রাষ্ট্রের স্বরূপ; বর্তমান মুসলিম বাংলা অনৈসলামিক ভাবধারাও হিন্দু প্রভাব (১ম ও ১য় খণ্ড); আশা মরীচিকা (সামাজিক উপন্যাস); কারবালা (কাব্য); সিরাজদ্দৌলা (কাব্য); পলাতক (কাব্য) ও বন্দিনী বাদীর বেদনা প্রথম ছয়খানি কাব্যের পাণ্ডুলিপি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়েছিল বলে- বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক ড. মুহম্মদ এনামুল হক সাহেবের এক স্বীকৃতি পত্র থেকে জানা যাচ্ছে (১৭-৩-৫৮ তাং)। পাণ্ডুলিপিগুলি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশের জন্য দেওয়া হয়েছিল।  ১০ জুন, ১৯৬২ সালে লন্ডন থেকে লিখিত ড. হাসান জামান এর পত্র থেকে জানা যায়, কবির সব প্রকাশিত গ্রন্থ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। কবি মোহাম্মদ গোলাম হোসেন সম্ভবত বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক শিক্ষিত কবি। তিনি গদ্য পদ্য উভয় রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কবির আত্মজীবনী (অ-প্রকাশিত) পাঠে জানা যায়, বিখ্যাত সুধাকর পত্রিকার সম্পাদক জনাব শেখ আবদুর রহীম, মানব মুকুট রচয়িতা এয়াকুব আলী চৌধুরী, ইসলাম দর্শন পত্রিকার সম্পাদক আবদুল হাকীম, প্রখ্যাত লেখক ও সাহিত্যিক ডা. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান প্রমুখ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কবি মোহাম্মদ গোলাম হোসেন ১৯৬৪ সালের ৫ই এপ্রিল, ইন্তেকাল করেন। বালিয়াডাঙ্গার পারিবারিক করবস্থানে তাঁর মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়।

মন্তব্য: