1. স্মরণীয় বরণীয়

ফররুখ আহমদ (১৯১৮ – ১৯৭৪)

কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী ও মাতার নাম বেগম রওশন আখতার। রমজান মাসে জন্ম বলে ফররুখের দাদী তাঁকে ‘রমজান’ বলে ডাকতেন। ছয় বছর বয়সে কবি তাঁর মাকে হারান। তারপর দাদীই তাঁকে মায়ের স্নেহে লালন-পালন করেন।  ফররুখের লেখাপড়া শুরু হয় নিজ গ্রামের পাঠশালায়। ঘরে তিনি আরবি, ফারসিও শেখেন। কবি শৈশব ও কৈশােরে তাঁর দাদীর নিকট থেকে শুনতেন, তাজকেরাতুল

আওলিয়া”, ‘কাসাসুল আম্বিয়া’, প্রভৃতি বিখ্যাত সব পুঁথির কাহিনী। ফররুখ আহমদ পুঁথির খুব ভক্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর দাদীই তাঁর মধ্যে অনুপ্রেরণার বীজ বপন করেছিলেন। গ্রামের পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ভর্তি হন কলকাতার মডেল এম.ই স্কুলে। এরপর তিনি ভর্তি হন বালিগঞ্জ হাইস্কুলে। এ স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা কবি গােলাম মােস্তফা। পরে তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। খুলনা জেলা স্কুলের ম্যাগাজিনেই ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। কবি আবুল হাসেম ছিলেন স্কুলের ম্যাগাজিন সম্পাদক। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজলও এ সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। এরপর তিনি প্রথমে দর্শন পরে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও পরে সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু নানা কারণে তিনি আর পড়াশােনা চালাতে পারেন নি। ফররুখ আহমদের কলেজজীবনে শিক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে ও সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী। ফররুখ আহমদকে সে সময় অনেকেই “দ্বিতীয় আশুতােষ’ নামে আখ্যায়িত করতাে। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়, ফতেহ লােহানী, শিল্পী কামরুল হাসান, কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় প্রমুখ। অধ্যাপক বিশী তাঁর কবিপ্রতিভায় চমৎকৃত হয়ে তাঁকে তরুণ সেক্সপীয়র’ নামে অভিহিত করেন।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিখ্যাত ‘কবিতা’পত্রিকায় ফররুখ আহমদের কয়েকটি কবিতা ছাপেন, তখন সবেমাত্র তিনি কলেজের ছাত্র। পড়াশােনায় ক্ষান্ত দিয়ে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে কবি তাঁর খালাতাে বােন সৈয়েদা তৈয়বা খাতুন (লিলি)কে বিয়ে করে সংসারী হন। জীবিকান্বেষণে কবি বিভিন্ন চাকরিতে নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে কলকাতার আই.জি প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে মাসিক মােহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৪৮ সালে জলপাইগুড়িতে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি ঢাকায় এসে প্রথমে অনিয়মিত পরে নিয়মিত আর্টিষ্ট হিসেবে ঢাকা বেতারে চাকরি নেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ বেতারের চাকরিতে বহাল থাকেন। ঢাকা বেতারের স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ফররুখ আহমদ দীর্ঘদিন ছােটদের আসর ‘কিশাের মজলিশ’ পরিচালনা করেন। বেতারের প্রয়ােজনে তিনি অসংখ্য গান, কবিতা, নাটিকা, শিশুতােষ রচনা, গীতিকা, গীতিনাট্য, গীতিবিচিত্রা ইত্যাদি লিখেছেন। কবিতা আবৃত্তি করেছেন, মাঝেমধ্যে পুঁথিপাঠেও অংশগ্রহণ করেছেন। ফররুখ আহমদ মুসলমানদের এ হৃত গৌরব ও ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রথম যৌবনে ফররুখ আহমদ কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। অল্প দিনেই তিন কমিউনিজমের অসারতা উপলব্ধি করে ইসলামের আশ্রয়গ্রহণ করেন। তাঁর সব লেখার মধ্যেই ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও জীবনবােধের জয়গান গেয়েছেন।  মুসলমানদেরকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে, মুসলমানদের অতীত গৌরবময় পথে চলে হারানাে মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য। এ জন্য তাঁকে বলা হয় ইসলামী রেনেসাঁর শক্তিমান কবি। খুলনা জেলা স্কুল ম্যাগাজিনে ১৯৩৭ সালে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা ছাপা হবার পর উক্ত একই বছরে বুলবুল ও মোহাম্মদী ছাড়াও আজাদ, সওগাত, কবিতা, দিগন্ত, মৃত্তিকা, অরণি, পরিচয় প্রভৃতি পত্রিকায় একের পর এক তাঁর বহু কবিতা ছাপা হয়। তার প্রকাশিত রচনাবলী: কবিতা: সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), আজাদ কর পাকিস্তান (১৯৪৬), সিরাজাম মুনীরা (১৯৫২), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), কাফেলা (১৯৮৪), হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৫০), দিলরুবা (১৯৯৪), হাবেদা মরুর কাহিনী, নির্বাচিত কবিতা (১৯৯২),  মহাকাব্য- হাতেম তায়ী (১৯৯৬), নৌফেল হাতেম (গীতিনাট্য (১৯৬১); ব্যঙ্গকবিতা: অনুস্বার, বিসর্গ; ঐতিহাসিক- অনৈতিহাসিক কাব্য (১৯৯১), হাল্কালেখা, তসবিরনাম, রসরঙ্গ ও ধােলাইকাব্য।

গান : রক্ত গােলাব, ‘মাহফিল (হামদ ও নাত), কাব্য-গীতি। নাটক: রাজ রাজড়া (গদ্য ব্যঙ্গ নাটিকা)। শিশুসাহিত্য: পাখীর বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৬৮), নতুন লেখা (১৯৬৯), ছড়ার আসর (১) (১৯৭০), ছড়ার আসর (২), ছড়ার আসর (৩), চিড়িয়াখানা, ফুলের জলসা, কিসসা কাহিনী, সাঁঝ সকালের কিস্সা, আলােকলতা, খুশীর ছড়া, মজার ছড়া, পাখীর ছড়া, রং মশাল, জোড় হরফের খেলা, পড়ার শুরু, পােকা মাকড়। গল্প : ফররুখ আহমদের গল্প (১৯৯০); পাঠ্যবই : নয়াজাত, প্রথম ভাগ (১৯৫০), নয়াজাত, দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫০), নয়াজাত, তৃতীয় ভাগ (১৯৫০), নয়াজাত, চতুর্থভাগ (১৯৫০)। অনুবাদ: কুরআন-মঞ্জুষা, ইকবালের নির্বাচিত কবিতা।   

সাধারণভাবে তাঁকে মুসলিম রেনেসার কবি নামে অভিহিত করা হলেও তিনি প্রকৃত একজন খাঁটি বাঙালি কবি।  আধুনিক বাঙালি মুসলিম জাগরণে ফররুখ আহমদের বিশেষ অবদানের প্রেক্ষিতে, পাঞ্জেরী ও সাত সাগরের মাঝি তাঁকে মুসলিম রেনেসার কবি বলে অভিহিত করেছে। কাব্য, নাটক, শিশুতােষ ছাড়াও কবিতাতেও তাঁর খ্যাতি আছে। ফররুখ আহমদ তাঁর জীবনকালে যেসব সাহিত্যপুরস্কার পান তা নিম্নরূপ : প্রেসিডেন্ট পুরস্কার : প্রাইড অফ পারফরম্যান্স (১৯৬০), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০)। ‘হাতেম তা’য়ী গ্রন্থের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬)। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য তাঁকে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব প্রদান করেন কিন্তু কবি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই বছরই হাতেম তায়ী’ কাব্যের জন্য আদমজী পুরস্কার পান। মরণােত্তরকালে তাঁকে এ পর্যন্ত পাঁচটি পুরস্কার দেয়া হয়। সেগুলাে হলোে- একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৪), আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদ্যাপন জাতীয় কমিটি প্রদত্ত ভাষাসৈনিক পদক(২০০০), কিশাের কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার-২০০৯।

মুসলিম সংস্কৃতি আর গৌরব গাঁথা বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কবি ফররুখ আহমদ অনন্য ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের অধিকারী। এই কবি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মগ্রাণ, বন্ধুবৎসল ও মেহমান নেওয়াজ। লােভ ও খ্যাতির প্রতি তাঁর কোনাে মােহ ছিল না। রেডিওর সামান্য চাকরি করে তিনি কোনােরকমে সংসার চালাতেন। টাকা-বিত্ত, পদমর্যাদা, ছােট চাকরি ছেড়ে বড় চাকরির চেষ্টা ইত্যাদি কোনাে কিছুর দিকে তাঁর খেয়াল ছিল না। কবির জীবনের শেষ দিনগুলাে ছিল খুবই বেদনাদায়ক। ইসলামী মূল্যবােধই

ছিল তার অপরাধ। আর এ জন্যই তিনি চাকরিচ্যুত হন। চাকরি হারিয়ে দারুণ অর্থকষ্টে পড়েন। আর এ সময়ে বিনা চিকিৎসায় কবির বড় মেয়ে ইন্তেকাল

করেন। বড় ছেলের মেডিকেল কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, নিজেও ওষুধ-পথ্যের অভাবে রােগ জর্জর অবস্থায় দিন দিন কংকালসার হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, অবশেষে এভাবে একদিন নীরবে মৃত্যুর করাল গ্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেন

১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, ৫৬ বছর বয়সে। কিন্তু তাঁর দুঃখ-কষ্টের কথা কারাে নিকট প্রকাশ করেননি বা কারাো নিকট সাহায্যের আবেদন করেননি। তাঁর জীবনে যেমন দুঃখ এসেছে, তেমনি অযাচিতভাবে অনেক সুযোেগ ও প্রলােভনও এসেছে। সামান্য একটু নীতিবােধ বিসর্জন দিলে তিনি অনায়াসে অনেক কিছুর মালিক হতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা কখনাে করেননি। এমন উদার, নীতিবান, মহৎ দৃঢ়চেতা নিষ্কলুষ চরিত্রের আদর্শ চরিত্রের মানুষ দেশে সত্যিই অতিশয় দুর্লভ। মৃত্যুর পরও কবিকে নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকার কোন গােরস্থানে এ অস্পৃশ্য লাশের জায়গা হয়নি। অবশেষে সে সমস্যার সমাধান করেন কবি বেনজির আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই আমার পাশেই থাকবে। ঢাকার শাহজাহানপুরে কবি বেনজির আহম্মদের নিজের বাড়িতেই কবিকে সমাহিত। করেন। মৃত্যুর পর কবি বেনজির আহম্মদকেও তাঁর পাশে দাফন করা হয়েছে।

মন্তব্য: