1. স্মরণীয় বরণীয়

সৈয়দ আলী আহসান (১৯২০-২০০২)

জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক, সমালােচক এবং কবি। চল্লিশ দশকের একজন খ্যাতিমান কবি হিসাবে সৈয়দ আলী আহসান খুবই পরিচিত। সৈয়দ আলী আহসান মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন আলােকদিয়া নামক গ্রামে সরকারি তথ্যমতে ২৬ মার্চ

১৯২২ সালে এবং পারিবারিক মতে, ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন।তার পিতার নাম মরহুম সৈয়দ আলী

হামেদ ও মাতার নাম মরহুমা সৈয়দ কামরুন্নেগার খাতুন। জানা যায়, মিরপুরের মাজারে শায়িত শাহ আলী বাগদাদী ছিলেন তার পূর্ব পুরুষ। তিনি তার অধঃস্তন দ্বাদশ পুরুষ। সৈয়দ আলী আহসানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিকভাবে। বাড়িতেই তিনি আরবি, ফার্সি, উর্দু ও ইংরেজি হরফ শেখেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের পুরােটা সময় কেটেছে ঢাকায়। ১৯৩৭ সালে আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ ঈসায়ী ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান (ইংরেজি) ১৯৪৩, স্নাতকোত্তর (ইংরেজি) ১৯৪৪ ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ঢাকা সরকারি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান কবি কাজী নজরুল কলেজ) কয়েক মাস শিক্ষকতা করেন।

১৯৪৫ সালে হুগলী ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। ঐ বছরের শেষের দিকে কলকাতা অল ইন্ডিয়া রেডিও তে প্রােগ্রাম এসিসট্যান্ট হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিও পাকিস্তানে দু’বছর চাকরি করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক হিসাবে যােগদান করেন। ১৯৫৪-১৯৬০ পর্যন্ত করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৬০-১৯৬৬ পর্যন্ত ৭ বছর বাংলা একাডেমির পরিচালক হিসাবে কর্মরত ছিলেন।১৯৬৭-১৯৭১ প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান, বাংলা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; এই সময় তিনি পরপর তিনি বছর কলা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হন। মার্চ ১৯৭১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পক্ষে প্রবল জনমত তৈরি করেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৫ সালে পুনরায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব চাকরিতে ফিরে যান। কয়েক মাস পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৭ পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার (মন্ত্রীর পদমর্যাদা) দায়িত্ব পালন। ১৯৭৮ এ আবার শিক্ষকতায় ফিরে যান; প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক এবং পরে ইনস্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস-এ চারুকলা বিষয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন এবং ঐ বছরেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে চেয়ারম্যান পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন। তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র

হয়েও বাংলায় অধ্যাপনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। তিনি লিখেছেন সাহিত্যের বহু শাখা প্রশাখায়। 

তার প্রকাশিত গ্রন্থ: তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০৫। অন্য সূত্রমতে তার প্রকাশিত এন্থের সংখ্যা ছিল ১৫০ এর বেশি। প্রবন্ধ পবেষণা : বাংলাসাহিত্যের হতিবৃত্ত (যুগ্ভাবে, ১৯৫৪); পন্মাবতী (১৯৬৮), মধুমালতী (১৯৭২); নজরুল ইসলাম (১৯৫৪); ‘Essays inBengal Literature’ (১৯৫৬); কৰি মধুসদন (১৯৫৭); কবিতার কথা অনুষঙ্গে (১৯৭০); রবীন্দ্রনাথ, কাব্য বিচারের ভূমিকা (১৯৭৪); মধুসুদন, কবিকৃতি ও কাব্যদর্শ (১৯৭৫); ‘আধুনিক জার্মান সাহিত্য (১৯৭৬), সতত স্বাগত (১৯৮৩); শিল্পবােধ ও শিল্পচৈতন্য (১৯৮৩), সরহপার দেহাকোষ তি (১৯৯৩); বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস: প্রাচীন যুগ (১৯৯৪), আমদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ (১৯৯৬) মৃগাবতী (১৯৯৮), ‘Our Hlenilage (১৯৪৮); Step to English, (৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম, ও ৮ম শ্রেণীর ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক (১৯৫০-৫১); গল্প : ‘গল্প সংগ্রহ সম্পাদনা (১৯৫২); ‘গল্প সংকলন (১৯৬৯); গল্প সঞ্চয়ন (ড. শহীদুল্লাহ সহযােগ) (১৯৫৩); কবিতা : অনেক আকাশ (১৯৫৯); ‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬৪); ‘সহসা সচকিত (১৯৬৫); উচ্চারণ (১৯৬৮); ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৪); ‘চাহার দরবেশ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৫); ‘সমুদ্রেই যাব (১৯৮৭); ‘রজনীগন্ধা(১৯৮৮); “নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৬); শিশুতােষ : ‘কখনাে আকাশ (১৯৮৪); আত্মজৈবনিক উপন্যাস : ‘জিন্দা বাহারের গলি (১৯৮৫); ‘স্রোতোবাহী নদী (১৯৮৯)। ভ্রমণকাহিনী : ‘প্রেম যেখানে সর্বস্ব (১৯৮৭); হে প্রভু আমি উপস্থিত। আত্মজীবনী : “আমার সাক্ষ্য (১৯৯৪); অনুবাদ : ইকবালের কবিতা (১৯৫২); প্রেমের কবিতা (যুগ্মভাবে-১৯৫৮); ‘হুইটম্যানের কবিতা (১৯৬৫); ‘ইডিপাস (১৯৬৮); ‘সাম্প্রতিক জার্মান গল্প (১৯৭০); ‘জার্মান সাহিত্য একটি নিদর্শনী (১৯৭৪); উইলিয়াম মেরিডিথের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮২); ‘সন্দেশ রাসক (১৯৮৭); ‘নাহুজুল বালাঘা (১৯৮৮)। সৈয়দ আলী আহসান তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এসব দেশে তিনি গিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিনিধিত্ব করতে।

পদক পুরস্কার : কবিতা জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭); দাউদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮); (প্রত্যাখ্যান), সুফি মােতাহার হােসেন স্বর্ণপদক (১৯৬৭); একুশে পদক (১৯৮৩); নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮৫); মধুসূদন সাহিত্যপুরস্কার (১৯৮৫); স্বাধীনতা স্বর্ণপদক পুরস্কার (১৯৮৮); Officer del. orore Des Arts Et Desletters. Paris (1992); হিন্দিভাষা ও সাহিত্য অবদানের জন্য ১৯৭৪ এ নাগপুরের বিশ্ব হিন্দি সম্মেলন থেকে পেয়েছেন সম্মাননা পত্র।

২৫ জুলাই ২০০২ ঢাকার কলাবাগানের নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দাফন করা হয়।

মন্তব্য: