1. সদর

মাগুরা সদর অঞ্চলের ধর্মীয় উৎসব

মাগুরা সদর উপজেলায় মুসলমান ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের বসবাসই প্রধান। এছাড়া কিছু খ্রীস্টান ধর্মের কিছু পরিবারের বাস রয়েছে এ উপজেলায়। এই তিন ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্ন সময় তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে মেতে ওঠে। 

ঈদুল ফিতরঃ মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এর আচার অনুষ্ঠানের সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। ঈদ শব্দের শাব্দিক অর্থ খুশি। এক মাস রোজা পালন শেষে ঈদ উৎসবের আনন্দ শুরু হয় সকালে ঈদগাহে জামাতে নামাজের মধ্য দিয়ে। পরলোকের আনন্দ প্রাপ্তির অভিপ্রায়ে ধনী-গরিব সর্বশ্রেনীর মানুষ এক কাতারে দাড়িয়ে নামাজ শেষে কোলাকুলির ভেতর প্রতিটি মুসলমান উপলব্ধি করে অনাবিল সুখ ও আনন্দ। ঈদের মাঠের পাশে উৎসবীয় আমেজ সৃষ্টি হয়। শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় ঈদগাহ প্রাঙ্গন। আর ইহলোকের আনন্দ ভোগের মধ্যে রয়েছে সুন্দর পোশাক পরিধান, ভালো খাবারের আয়োজন, গরীব-মিসকিনদের আপ্যায়ন এবং সামাজিক মেলামেশা ও আত্নীয়-স্বজনের পুনর্মিলনীর আনন্দ। 

ঈদুল আযহাঃ ঈদুল ফিতরের পর মুসলমানদের আর একটি ধর্মী উৎসব ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতরের ঠিক দুই মাস এগার দিন পর অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল আযহা। আনুষ্ঠানিকতার দিক দিয়ে ঈদুল ফিতরের মতোই অনেকটা। তবে, এই উৎসবের বড় আকর্ষণ হলো কোরবানী। ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে মূলত হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর কোরবানীর মাধ্যমে যে ত্যাগ, সেই ত্যাগের মহিমাকেই স্মরণ করা হয়। কোরবানীকে কেন্দ্র করে মাগুরার প্রতিটি মুসলিম পরিবারেই সৃষ্টি হয় উৎসবীয আমজে।       

ফাতেহা দোয়াজদাহামঃ মাগুরা অঞ্চলের মুসলমানদের তৃতীয় ধর্মীয় উৎসব হলো ফাতেহা দোয়াজদাহাম। ফাতেহা দোয়াজদাহাম হলো মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর ইহলোকে আবির্ভাব ও পরলোকে গমন দিবস। আরবী সনের প্রতি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে দিনটি উদযাপন করা হয়। এই দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রতিটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এর আয়োজন করা হয়। এই মিলাদে বিভিন্ন বয়সী পুরুষ অংশগ্রহন করে। মিলাদ শেষে মিষ্টি বিতরণ বাড়িতে বাড়িতে উৎসবীয় আমেজ তৈরী করে। 

শবে বরাতঃ পবিত্র রমযান মাসের ১৫ দিন পূর্বে অনুষ্ঠিত হয় শবে বরাত। দিনটির তাৎপর্য হলো আল্লাহর হাতে মানুষের বাৎসরিক ভাগ্য নির্ধারণ। এই হিসাবে শবে বরাত এর সারারাত এবাদত বন্দেগী করে ধর্মভীরু মুসলিম নরনারী। সারারাত প্রতিটি মসজিদে এবাদত বন্দেগি চলে। তবে, আমাদের সমাজে শবে বরাতকে দেখা হয় অন্যভাবে অর্থাৎ সবার বরাত নিশ্চিত করা। ভাবা হয় এতেই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি। তাইতো প্রতিটি মুসলিম পরিবারে  রুটি হালুয়া তৈরীর ধুম পড়ে যায়। রুটির সাথে সংযোজিত  হয় মাংস। মাগুরা উপজেলার কিছু গ্রামে গরীর মিসকিনদের সারি বেধে বসিয়ে বিতরণ করা হয় রুটি হালুয়া। প্রকৃত অর্থে খাওয়ার সাথে শবে বরাতের এবাদত বন্দেগির তাৎপর্যের কোন মিল নেই। 

শবে কদরঃ পবিত্র রমজান মাসের ২৭ তারিখ রাত মুসলমানদের এবাদত বন্দেগির একটি রাত। মূলত ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী এ রাতেই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল এবং এ রাতেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। তাইতো এ রাতেই মুসলিম নরনারী সারারাত আরাধনা-উপাসনা করে থাকে। ২৭ রমজান এশার নামাজের পর প্রতিটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় এবং মিষ্টি বিতরণ করা হয়।  

ওয়াজ মাহফিল ও ইসালে সওয়াবঃ মাগুরা শহরসহ বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন মাদ্রাসা, পীরের দর্গা বা পাড়া-মহল্লায় ইসলামী বিধি বিধান প্রচারের উদ্যেশ্যে ধর্মসভা, ওয়াজ মাহফিল ও ইসালে সওয়াব এর আয়োজন করা হয়। এসব মাহফিল উপলক্ষ্যে ঐসব অঞ্চলে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  

দুর্গাপূজাঃ আশ্বিন মাসের ১৫ তারিখে মাগুরা জেলাব্যাপী হিন্দু অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রাম ও বাজারেই দুর্গপূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার কারণে এ পূজা উপলক্ষ্যে একটি উৎসবমূখর আমেজ সৃষ্টি হয় মানুষের মাঝে। 

কালীপূজাঃ কার্ত্তিক মাসের ৮ তারিখে শত্রæজিৎপুর, নাওভাঙা, পয়ারী এবং নড়াইল জেলা সংলগ্ন গ্রাম ও বাজার সমূহে অনেক ধুমধামের সাথে কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

কাত্তায়ানী পূজাঃ মাগুরার কাত্তায়ানী পূজা সমগ্র বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের অন্যতম নাম করা পূজা অনুষ্ঠান। ১৫ কার্ত্তিক থেকে চার দিন ব্যাপী শ্রী শ্রী কাত্তায়ানী পূজা করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ভারত, নেপাল ও শ্রীলংকা থেকে ভক্তবৃন্দ এই পূজা উপলক্ষ্যে মাগুরায় আসেন।  

শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমিঃ ভাদ্র মাসের ৩ তারিখে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে ঐতিহাসিক  জন্মাষ্টমীর মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। এটি দেশের অন্যতম বৃহত্তম শোভাযাত্রা। নিজনান্দুয়ালীর নিতাই গৌর গোপাল সেবাশ্রম থেকে শুরু হয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করে সাতদোহার ল্যাংটা বাবার আশ্রমে শেষ হয়। ২৫-৩০ হাজার লোকের প্রসাদ বিতরণ করা হয় । অনুষ্ঠানটি জেলার যেখানেই হিন্দু মন্দির আছে সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়। জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে ঘরে ঘরে শ্রী কৃষ্ণের পূজা দেওয়া হয়। 

লক্ষীপূজাঃ লক্ষীপুর গ্রামে জাকজমকপূর্ণভাবে লক্ষীপূজা  অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও জেলার প্রতিটি হিন্দু পরিবারেই গৃহিনীরা লক্ষী পূজা করে থাকে। 

স্বরস্বতী পূজাঃ লক্ষীপুর গ্রামে উৎসবীয় আমেজে স্বরস্বতী পূজাও অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া জেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা স্বরস্বতী পূজার আযোজন করে থাকে। এ পূজায় প্রসাদ বিতরণ খুবই প্রাণবন্ত হয়ে থাকে। 

জগদ্ধাত্রি পূজাঃ মাগুরার নিজনাদন্দুয়ালী গ্রামে জগদ্ধাত্রি পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বাংলা ১৩৩০ সনে নির্মিত একটি জগদ্ধাত্রি পূজা মন্ডপ রয়েছে।

বিশ্বকর্মা পূজাঃ শ্রী শ্রী বিশ্বকর্মা পূজা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখে। যারা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করে তারা বিশ্বকর্মা ঠাকুরের পূজা করে থাকেন। 

চৈত্রির পূজাঃ মাগুরা সদর উপজেলার মালন্দ গ্রামে চৈত্রির পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

শিব চতুর্দশী পূজাঃ মাগুরা সদর উপজেলার মাধবপুর গ্রামে শিব চতুর্দশী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

বাসন্তি পূজাঃ বসন্তকালে মা দুর্গা দেবীর পূজা করা হয় মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চলে। বাসন্তি পূজাকে কালের পূজা বলে আখ্যায়িত করা হয়। আশ্বিন মাসের দূর্গা পূজাকে অকালের পূজা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। 

শিবপূজাঃ বেরোইল গ্রামে শিবপূজার মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার শেষে শিব রাত্রে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। 

কেশবব্রত অনুষ্ঠানঃ বৈশাখ মাসব্যাপী মাগুরার শহরতলী গ্রাম নিজনান্দুয়ালীতে অবস্থিত নিতাইগৌরগোপাল আশ্রমে অনুষ্ঠিত হয় কেশবব্রত অনুষ্ঠান। মাসব্যাপী সংযম পালন করে ভক্তবৃন্দ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগমন ঘটে প্রখ্যাত আলেঅচকবৃন্দের। প্রতিরাতে এখানে প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে ভক্তবৃন্দের জন্য।  

চড়ক পূজাঃ বৈশাখের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে চড়ক পূজা অুনুষ্ঠিত হয়। মাগুরা সদরের আড়াইশত ও টেঙাখালী গ্রামে ও শ্রীপুর উপজেলার গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে থাকে। এছাড়া ৩০ চৈত্র শিব ও দুর্গার বিয়ে হয়। এ পূজা উপলক্ষ্যে প্রচুর ভক্ত ও আতœীয় স্বজনের আগমন ঘটে এ মেলাসমূহে।   

শ্রী শ্রী লোকনাথের তিরোধান উৎসবঃ জৈষ্ঠ্য মাসের ২০ তারিখে যুব সমাজের আধ্যাতিœক প্রাণপুরুষ শ্রী শ্রী লোকনাথ বাবার তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে দরিমাগুরার ছানাবাবুর বটতলা প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রথমদিন বর্ণাঢ্য র‌্যালী শহর প্রদক্ষিণ করে। দ্বিতীয় দিন দেশের বিশিষ্ট বক্তাদের অংশগ্রহনে ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় দিনে ধর্মীয় সংগীতের আয়োজন করা হয়। প্রতিদিন ভক্তদের প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুষ্ঠানে যুব সমাজের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০০৮ সাল থেকে অনুষ্ঠানটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।  

নামযজ্ঞঃ ল্যাংটা বাবার তিরোধান উপলক্ষ্যে বৈশাখ মাসের ৩০ তারিখে মাগুরা শহরসংলগ্ন সাতদোয়া পাড়ার আশ্রমে মহতী নামযজ্ঞের আয়োজন করা হয়। এই নামযজ্ঞে ল্যাংটা বাবার প্রচুর ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে।

পাঠা বলিঃ বৈশাখ মাসের ৩০ তারিখে মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত মাগুরা তথা অত্র এলাকার সবচেয়ে পুরাতন মন্দির আঠারখাদা গ্রামের ‘সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির’ এ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র উৎসব ‘পাঠা বলি’ দিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তবৃন্দ উপস্থিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন রোগমুক্তি ও বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির আশায় ভক্তরা এখানে বিভিন্ন ধরনের মানত করে থাকে। উপরোক্ত তারিখে এসব মানত পরিশোধ করা হয়। 

রথযাত্রাঃ হিন্দুদের এক জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা। মূলত কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রার রথযোগে মাতুলালয়ে যাত্রার স্মরণে উদযাপন করা হয় এই উৎসব। কালক্রমে এটি পরিণত হয়েছে জগন্নাথদেবের উদ্দেশে ভক্তি নিবেদনের অনুষ্ঠান। রথের রশি টানার অর্থ পূণ্যার্জন। এর সাথে যোগ হয়েছে আনন্দভোগের নানা আয়োজন। জৈষ্ঠ্য মাসের ৩১ তারিখে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। জেলার সবচেয়ে পুরাতন রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় সাতদোহা ল্যাংটা বাবার আশ্রমে। নিজনান্দুয়ালীর নিতাই গৌর গোপাল সেবাশ্রম, দরি মাগুরার ছানাবাবুর বটতলায় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। 

শ্রী কৃষ্ণের ঝুলন যাত্রাঃ ২৩ শ্রাবণ সাতদিন ব্যাপী শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা অনুষ্ঠিত হয় নিজনান্দুয়ালী গ্রামে অবস্থিত নিতাই গৌর গোপাল সেবাআশ্রমে। শ্রী কৃষ্ণের ভজন কীর্ত্তণ, আলোচনা ও গীতাপাঠ চলে পুরো সাত দিন। বিভিন্ন জেলার ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে এখানে। প্রসাদও বিতরন করা হয় প্রতিদিন।

হরিবাসরঃ হরিবাসর হলো এক ধরণের কীর্ত্তন। এছাড়া হিন্দু ধর্ম বিষয়েও আলোচনা করা হয়। বছরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে একটি অনুষ্ঠান করা হয়। মাগুরা সদরের চন্দন প্রতাপ গ্রামের বিকাশ চন্দ্র দাসের (৪৭) সাথে কথা বললে তিনি বলেন পূর্ব বাড়েলা গ্রামে দুলাল সরকারে নেতৃত্বে একটি হরিবাসর গানের দল রয়েছে। মাগুরার হিন্দু অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে হরিবাসর গান করা হয়।   

রাশ উৎসবঃ মাগুরা সদরের আড়াইশত গ্রামে শ্রী কৃষ্ণ সম্পর্কিত উৎসব অনুষ্ঠিত হয় যার নাম রাশ উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়।  

তথ্যঃ

তরুন কুমার ভৌমিক 

পিতাঃ মৃত হিমাংশু শেখর ভৌমিক

বয়সঃ ৪৩ বছর

গ্রামঃ নিজনান্দুয়ালী

উপজেলা ও জেলাঃ মাগুরা

পেশাঃ বিভিন্ন লোকজ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে সাজসজ্জা।

মন্তব্য: