1. ইতিহাস

মাগুরার সংস্কৃতির আলোকিত ভুবন।

সাগর জামান

চিরগর্বের শহর মাগুরা সংস্কৃতি চর্চা ও লালনের ক্ষেত্রে কখনাে পিছিয়ে ছিলনা। বরং বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মনৈপুণ্যে উজল ভূমিকা পালন করে এসেছে। সাবেক মহকুমা এবং আজকের জেলা মাগুরার সে ঐতিহ্য আপন গরীমায় সমুজ্জল। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এ তৎপরতায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। মাগুরা থিয়েটার যা বর্তমানে মাগুরা টাউন হল নামে পরিচিত হয়েছে, তা ছিল মাগুরার সাংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

স্থানীয় বিজ্ঞ আইনজীবিদের উৎসাহ পৃষ্ঠপোষকতাসহ প্রত্যক্ষ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান তখন নিত্য উপহার দিত বকমারী নাটক ও অনুষ্ঠানাদি। সে চর্চা চলছে দীর্ঘদিন। সে স্বর্ণযুগের অভিনেতাদের মধ্যে স্বর্গীয় হরিশচন্দ্র দত্ত, দুর্গাদাস গাঙ্গুলী, ভোলানাথ শিকদার, প্রশান্তকুমার, নরেশ চক্রবর্তী, পবিত্র দাশগুপ্ত, জগবন্ধু হালদারসহ অনেকেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এছাড়াও খান জিয়াউল হক, আঃ ছামাদ কাঠু মিয়া, সমরেশ রায় চৌধুরী, পুলিশ অফিসার কাঞ্চন ঘোষাল, সদরুল আলম পানু, আমিনুল ইসলাম চাঁদু, আবু জোহা পিকুল, কামরুল হুদা নীহার, কাজী কাওহার ওরফে কাজীর বেটা, শান্তিপদ শিকদার (আঠারখাদা) আঃ মান্নান, মরহুম তােতা ভাই প্রমুখ ছিলেন টাউন হল রঙ্গমঞ্চের প্রাণ ও শক্তি।

মাগুরার পার্শ্ববর্তী নিজনান্দুয়ালী গ্রামের মরহুম শাহজাহান সরদারের প্রচেষ্টায় নতুন বাজার এলাকায় যাত্রার আঙ্গিকে অভিনয় প্রদর্শনী সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে চাঙ্গা রাখতে সহায়ক ছিল। পূজা পার্বণ বা বিভিন্ন উৎসবকে ঘিরে আঠারােখাদা, নিজনান্দুয়ালী, নতুন বাজারে বিরাট আয়োজনে মাতিয়ে তুলতো শাহজাহান সরদারের সরস্বতী অপেরা। মাখনলাল অধিকারী, শান্তিপদ শিকদার, নুতন বাজারের ডি, এন, কুরী, সুধীর ঘােষ, আঠারােখাদার নিমুদা সহ আরো অনেকের সফল অভনয় আজো স্মৃতি হয়ে আছে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে টাউন হলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।

মাগুরা শহরের জামরুলতলা নামক স্থানও ছিল নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম স্থান। প্রয়াত কালীপদ বৈদ্য, সবদার মোল্লা, তারাপদ ভৌমিক ওরফে তারা কুরী, রণজিৎ কুমার মহরার, শিবুপদ ওরফে শিবুরাণী, শামসুল বারী প্রমুখ প্রাণবন্ত অভিনয়ে দর্শক শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখতেন।

মাগুরা জেলা সদরের সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি যখন মহকুমা মাগুরা শহরের একমাত্র এবং বেসরকারী বালিকা বিদ্যালয় ছিল তখনকার সাংস্কৃতিক তৎপরতায় এ প্রতিষ্ঠানটির ছিল গৌরবময় ভূমিকা। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শুধুমাত্র ছাত্রীদের অংশগ্রহণে “রামের সুমতি” “বিন্দুর ছেলে” নাটকের সফল মঞ্চায়ন সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল দুঃসাহসিক বিজয়। লক্ষীরানী সাহা, আকলীমা খাতুন, দীপালী, জলি, পলি, বিজলী, বুলু, নাজমা ছিলেন এ বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম সৈনিক। বিজলীর নৃত্য, বর্তমান মাগুরার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলতাফ হােসেনের পত্নী জলি (প্রয়াত) এর অভিনয় ও সঙ্গীত, মরহুম সৈয়দ আতর আলীর কন্যা বুলু এবং পুত্রবধু নাজমার আবৃত্তি ও অভিনয় আজো বয়ােজ্যেষ্ঠদের মুখে উচ্চারিত হয়।

যাটের দশকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে টানাপোড়েনের কারণে মাগুরার বুদ্ধিজীবী সাংস্কৃতিসেবীরা ভীষণভাবে আলোড়িত হয়ে পড়েন। এ সময় মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাবিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষ, অধ্যাপক এবাদত হোসেন ও কাজী সাইফুজ্জামানের কর্মপ্রচেষ্টায় সাংস্কৃতি বিভিন্ন বিভাগ সমৃদ্ধ হতে থাকে। নববর্ষ উদযাপন, বসন্ত বরণ, ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ স্মরণ প্রভ়ৃতির মাধ্যমে নিজেদের স্বরূপ অনেষণে মাগুরাবাসী সেদিন সচেতন থেকেছেন। তখনকার ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন এবং বিভিন্ন সময় নাটক, গীতি আলেখ্যের ধারাক্রমে ছাত্র সংসদ তাদের সরব উপস্থিতি প্রমাণ করেছে। এসব কাজে অধ্যাপক অসিত বরণ ঘােষের সহযােদ্ধা হিসাবে ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল আলিম, অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক আব্দুল আলিম, অধ্যাপক আব্দুস সেলিম, অধ্যাপক সেকেন্দার আলী প্রমুখ।

এ সময়ের আগে মাগুরা আরাে একজন গুণিজনকে পায়। তিনি হচ্ছেন মাগুরার তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক আসাফউদ্দৌলা। তার প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় সরকারী প্রতিষ্ঠান আর্ট কাউন্সিল ও ললিত কলা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে ললিত কলার নাম নিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীদের মাঝে টানাপােড়ন শুরু হয়। কেউ চান “আখেলী ললিত কলা” নামকরণ আবার কেউ চান মাগুরা ললিত কলা বিদ্যাপীঠ নামে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হােক। এ দ্বন্দ্ব থেকে দু’নামেই একসময় মাগুরায় পৃথক দু’টি প্রতিষ্ঠান চলতে থাকে। ললিত কলা হারিয়ে যায় এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে। ছােট্ট শহরে পৃথক দু’টি প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক তৎপরতায় সচেষ্ট থাকে।

স্বাধীনতাত্তোর সত্তর দশকে মাগুরার সংস্কৃতিতে আসে নুতন উজ্জীবন। সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী লেখক সবাই শরিক হলেন এবং সবার প্রচেষ্টায় আখেলী ললিতকলা, মাগুরা ললিতকলা বিদ্যাপীঠের সঙ্গে একিভূত হয়ে যায়। সর্বসম্মতিক্রমে সংগঠনটির নাম দেওয়া হয় “মাগুরা ললিতকলা শিল্পী সংস্থা। এসময় সাংস্কৃতিক অঙ্গণে ছিল সম্ভাবনাময় শিল্পীদের নিয়ে ঠাসা। শিল্পী না হয়েও আলী তারেক যেভাবে ললিতকলা শিল্পী সংস্থার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন তা স্মরণযোগ্য।

আশির দশকে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপিত হলাে শিল্পকলা পরিষদ, পরে শিল্পকলা একাডেমী। নোমানী ময়দানে শিল্পকলা একাডেমীর জন্য জায়গা বরাদ্দ হয়। ভবন নির্মিত হলে ললিতকলা শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা

শিল্পকলায় মিশে গেলেন। এ্যাডঃ আসাদুজ্জামান, খান জিয়াউল হক, চন্ডী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শতদল রায়, ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মধু বাবু, আবু জাফর, নজরুল ইসলাম টগর, ফকরুল ইসলাম তুরাণ, মোসাদ্দেক আলী মিন্টু, চৌধুরী ফেন্সী খালেদা বিউটি, সবিতা চট্টোপাধ্যায়, গৌর শিকদার, লীনা, রাণী, শরীফ আমিরুল হাসান বুলু, মোস্তফা মাকুল, আলী তারেক সাইদুর রহমান, মিহির লাল কুরী, এবং নাজমুল হাসান লােভন শিল্পকলা একাডেমীকে গতিশীল করার জন্য এগিয়ে আসেন। শিল্পকলা একাডেমী প্রাথমিক সময়ে একটি নাটক ও কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছিল। কর্তৃত্বের পালা বদলে শিল্পকলা একাডেমী ক্রমেই প্রাণহীন নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কেননা পরবর্তীকালে অদ্যাবধি মুগ্ধ করার মত কোন অনুষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমী উপহার দিতে পারেনি।

মাগুরার সাহিত্য ও সাংস্কৃতির বিকাশে মাগুরা প্রেসক্লাব গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন এ্যাডঃ দীপক রায় চৌধুরী খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, শরীফ আমিরুল হসান বুলু, অধ্যাপক সাইদুর রহমান, অধ্যাপক মিহির লাল কুরীর কর্তৃত্বে পরিচালিত প্রেসক্লাব নিজস্ব হলরুমে, কখনও প্রাঙ্গণে উপহার দিয়েছেন রুচিশীল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি। তারা লালন করেছেন স্থানীয় অনেক সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। 

মহকুমা আমলে নাট্যকর্মে একসময় উজ্জ্বলতা দেখিয়েছেন জাহিদুল ইসলাম বাকু। তার উদ্যোগ ও আয়ােজনে মঞ্চস্থ হয়েছে একাধিক নাটক। মাগুরার সাংস্কৃতিক অংগনকে আরাে সমূদ্ধ করার লক্ষ্যে সাংবাদিক শরীফ আমিরুল হাসান বুলু নৃত্যকলায় শিল্পী সৃষ্টিতে ছিলেন তৎপর। সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে সে তৎপরতা ব্যাপক প্রসার লাভ না করলেও জেলার অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে তিনি নৃত্যের নতুন মাত্রা সংযোগে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। হাফিজ খান, মিসেস বীথি, মিসেস রীতা খান, প্রমুখ ছিলেন এ তৎপরতার অন্যতম সহযোগী। শুধু তাই নয় তার প্রচেষ্টার ফসল মাগুরার আসাফউদ্দৌলা বাহার আজ বাংলাদেশ আনসার এর সাংস্কৃতিক দলের অন্যতম নৃত্যশিল্পী। ঢাকায় জাতীয় অনুষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সম্মানে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও টেলিভিশনে জনাব বাহার নৃত্য পরিবেশন করে মাগুরাকে গৌরবান্বিত করেছেন।

৮৫ সালের ৮ই জানুয়ারী বিবেক মজুমদার, রােমিও জালালী, মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, ভোলানাথ শিকদার প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে উদীচী শিল্পী গােষ্ঠী। উদীচী বছর পাচেক গৌরবময় ভূমিকা পালন করে। এরপর শুরু হয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। পরিণতিতে এক পর্যায়ে ভেঙ্গে যায় উদীচী। এ সময় বিবেক মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে প্রত্যয় সাংস্কৃতিক সংসদ। অন্যদিকে বিকাশ মজুমদার, আসাদ, আশিষ বিশ্বাস প্রমুখের প্রচেষ্টায় আবার গড়ে ওঠে উদীচী।

৮০’র দশকে মাগুরায় আরো একটি সংগঠন আলোড়ন সৃষ্টি করে। খান গোলাম মোস্তফা মাকুল, বিবেক মজুমদার আমীর হোসেন খান গড়ে তােলেন মাগুরা জেলা সাহিত্য সংসদ নামে এ প্রতিষ্ঠানটি। জেলায় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ছাড়া অসংখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলার সংস্কৃতির অবস্থানকে চাঙ্গা করতে অবদান রেখেছে মাগুরা জেলা সাহিত্য সংসদ।

মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার প্রয়াত নরেন্দ্র নাথ সিংহ দীর্ঘদিন ভারতে থেকে অবশেষে মাগুরা ফিরে আসেন। শহরের ঋষিপাড়ার প্রবেশ পথে তিনি স্থাপন করেন ‘মাগুরা সঙ্গীত একাডেমী’। এই একাডেমীর বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত প্রশিক্ষণে অংশ নিত সব বয়সের শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া প্রতিবছর সাংস্কৃতিক প্রতিযােগিতায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিযোগী/প্রতিযোগিনীরা মাগুরাকে আরো বেশী করে জানার সুযােগ পেয়েছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীরা লাভ করেছে স্বর্ণ, রৌপ্য পদক।

মাগুরার এককালের সাংস্কৃতিমনা পুলিশ সুপার জহুরুল হক তার কার্যকালে প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে মাগুরায় আয়ােজন করতেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। মাগুরায় সাংস্কৃতিক অঙ্গন উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে। তখন সবাই উৎসুক হতেন সে অনুষ্ঠান উপভােগের জন্য। স্থানীয় ও বহিরাগত শিল্পীদের অংশগ্রহণে সে অনুষ্ঠানের বিশাল আয়ােজন হতো কালেক্টরেট ভবনের উত্তর দিকের চত্বরে। কেননা উক্ত প্রাঙ্গনের উত্তরের ভবনগুলো (বর্তমানে আদালত) পুলিশ লাইনের ব্যারাক হিসাবে তখন ব্যবহার হতো। সুন্দর মনের অধিকারী পুলিশ সুপার জনাব জহুরুল হকের সে আয়োজনে আরো বেগবান হয়েছে মাগুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

১৯৯৩ সালের ১৫আগস্ট মাগুরায় গঠিত হয়, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ। মাগুরার নাট্যাঙ্গনের ভূমিকা বেশ আশাবাদী করে তোলে পুরো নব্বইয়ের দশক। ডায়মন্ড থিয়েটারের আবুবাসার আখন্দ, মাগুরা থিয়েটারের এম, এইচ, রহমান শিবলু, অনন্যার উজ্জ্বল, নবান্ন থিয়েটারের রুপম এবং থিয়েটার ইউনিটের শফিক উজ্জ্বলতা দেখিয়েছে। মাগুরা কালেক্টরেট ক্লাবও নাটক মঞ্চায়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে। পারফেক্ট ব্যান্ডগােষ্ঠী মাগুরায় ব্যান্ড সঙ্গীতের প্রচলন ঘটায়।

মন্তব্য: