1. স্মরণীয় বরণীয়

নিমাই ভট্টাচার্য (১৯৩১-২০২০)

 বাংলাসাহিত্যের এই খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নিমাই ভট্টচার্য ১৯৩১ সালে ১০ এপ্রিল কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস-মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন শরশুনা গ্রামে। তার পিতার নাম সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য। শৈশবেই তিনি মাতৃহারা হন।  পিতার সীমিত আয়ে অনেক দুঃখ কষ্ট অভাব অভিযোগের মধ্যে কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি স্কুলে তিনি শিক্ষাজীবন লাভ করেন। তিনি কলকাতা রিপন স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করার পর যশােরে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৪১ সালে যশাের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং নবমশ্রেণী পর্যন্ত (১৯৪১-১৯৪৬) এই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। তার পিতা সুরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্যও এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তীতে কিছুকাল এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। দেশ বিভাগের পর নিমাই ভট্টাচার্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন এবং পুনরায় কলকাতা বিপন স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন এবং রিপন কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে আই,এস, সি ও ১৯৫২ সালে বি.এ পাস করেন। দারিদ্র নিমাই ভট্টাচার্যকে পরাভূত করতে পারেনি। পরম উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ভাগ্যের সঙ্গে পাঞ্জা ধরেছেন তিনি। জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জন করার জন্য তার দৃঢ় মনােবল তাঁকে সাহায্য করেছিল। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার কর্মজীবন শুরু হয়। সাংবাদিকতা তার পেশা আর সাহিত্য সুষ্টি তার নেশা। কলেজে পড়তে পড়তেই খবরের কাগজের রিপাের্টার হলেন। দুপুর-বিকেল থেকে মাঝরাত্রির পর্যন্ত কাজ করেও প্রথম বছর কানাকড়ি জোটেনি। পরের বছর থেকে মাসিক “মাইনে’ হলো দশটা এবং তাও জুটত আটআনা একটাকার কিস্তিতে। একশ পঁচিশ টাকা মাইনের রিপাের্টারের চাকরি আশায় গণ্যমান্য বরেণ্য সাংবাদিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জুটেছে শুধু মিথ্যা আশ্বাস আর অপমান। একজন অতি প্রভাবশালী চিফ রিপাের্টার তার বাড়ি থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।  শ্যামলিমার দেখা পাওশার পর নতুন করে স্বপ্ন দেখে জীবনযুদ্ধে মেতে উঠলেন। ঘুরে বেড়ালেন দেশ-দেশান্তর, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশ। তারপর হঠাৎ একদিন অতীত দিনের দুঃখ কষ্ট ত্যাগ-তিতিক্ষা অপমান তিরস্কার আর প্রেম-প্রীতি ক্নেহ ভালবাসার রসদ সম্বল করেই কলম ধরলেন। ‘মেমসাহেব এই পর্যায়েরই একটি উপন্যাস।” ১৯৬৩ সালে তুষার কান্তি ঘােষ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘অমৃত বাজার পত্রিকায় নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পাঠকসমাজে সাহিত্যিক হিসেবে তার প্রথম পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে এই পত্রিকায় বিরতি ছাড়াই পরপর তার ‘রাজধানীর নেপথ্য’ “রিপাের্টার’ ‘ভিআইপি এবং পালামেন্ট স্ট্রিট’ নামক চারখানি উপন্যাস ঐ একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলাসাহিত্যে কোনাে পত্রিকায় এরূপ দৃষ্টান্ত নেই। তার ভাষায় ‘৪০ থেকে ‘৭০ এর দশক পর্যন্ত যারা প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন, তারা সাপ্তাহিক ‘দেশপত্রিকার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছেন, আমিই একমাত্র বিরল ব্যতিক্রম। নিমাই ভট্টাচার্য উপন্যাসিক হিসেবে পাঠকসমাজে পরিচিত। সপ্তাহিক অমৃত বাজার পত্রিকায় পরপর চারখানি উপন্যাস প্রকাশিত হলে এরপর থেকে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি পূর্ণোদ্যমে আরাে উপন্যাস লেখা শুরু করেন।

তাঁর উপন্যাসগুলাের নাম : মেমসাহেব, ডিপ্লোম্যাট, রাজধানীর নেপথ্য, ভিআইপি, যৌবন নিকুঞ্জে, অনুরােধের আসর, তােমাকে, হকার্স কর্ণার, কেয়ার অব ইন্ডিয়ান এ্যাম্বেসি, ভায়াডালহৌসী, পথের শেষ, রিপাের্টার, চিড়িয়াখানা, প্রবেশ নিষেধ, এ-ডি-সি, ইমন কল্যাণ, কেরানী, ব্যাচেলার, রবিবার, লাস্ট কাউন্টার, ইনকিলাব, সাব-ইন্সপেক্টর, সােনালী, পিকাডিলী সার্কাস, স্পেশ্যালট্রেন, মেলা, ভদ্দর লােক, অসমাপ্ত চিত্রনাট্য, অ্যালবাম, গােধুলিয়া, পেন ফ্রেন্ড এন্ড ক্লাস ফ্রেন্ড, প্রিয়বরেষু, মােগল সরাই জংশন, ওয়ান আপটু ডাউন, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, হরে কৃষ্ণ জুয়েলার্স, ককটেল, ‘ম্যাডাম, ইওর অনার, শেষ পরানির কড়ি, রাজধানী এক্সপ্রেস, বিশেষ সংবাদাতা প্রেরিত, উইং কমান্ডার, নিমন্ত্রণ, ভাগ্যং ফলিত সর্বত্র, অন্যদিন, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, রিটায়ার্ড, মাতাল, মিনিবাস, অ্যাংলাে ইন্ডিয়ান, জার্নালিস্ট জার্নাল, প্রবাসী, সদরঘাট, চিনাবাজার, স্বপ্নভঙ্গ, একচক্কর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ফুটবলার, অনেক দিনের মনের মানুষ, রত্না, নাচনী, বন্যা, নিউমার্কেট, নিউ এম্পায়ার ক্লাব, স্বার্থপর, কয়েদী, ফুটপাত, ভবঘুরে, শ্রেষ্ঠ গল্প, প্রথম নায়িকা, চেকপোস্ট, একান্ত নিজস্ব,এই আমি সেই আমি, শ্রেষ্ঠাংশে, সেলিম চিন্তি, ভালবাসা, প্রভৃতি প্রকাশিত উপন্যাসগুলি উল্লেখযােগ্য।

নিমাই ভট্টাচার্য একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। তিনি প্রায় শতাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের প্রণেতা। নিমাই ভট্টাচার্য বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কালীতলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর কন্যা দীপ্তি ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন।  কলকাতার টালিগঞ্জের শাশমল রােডের বাসায় বসবাসকালীন ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।।

মন্তব্য: