1. স্মরণীয় বরণীয়

শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন (১৯২৯-১৯৭১)

শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন ১৯২৯ সালের ১ মার্চ মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন শরুত্তনা গ্রামে এক সন্ত্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মােজারুল হক। তাঁর শৈশবকালেই তাঁর পিতা মৌলভী মােজারুল হক পরলােক গমন করেন। অভাব-অনটনের সংসারে তিনি বড়াে হতে থাকেন। তাঁর মা ছােট ছােট সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। এ সময় সিরাজ উদ্দিন হােসেনের বড় চাচা মৌলভী মােহাম্মদ এসহাক এম, এ, বি-টি সাহেব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মৌলভী মােহাম্মদ এসহাক সাহেবের তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে তিনি চাচার কাছে না থেকে চলে আসেন যশাের। যশাের জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। যশাের মাইকেল মধুসূদন কলেজে আই.এতে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে তিনি আই.এ পাস করেন। এরপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বি.এ ক্লাসে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ পাস করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি তাঁর চাচার দ্বারা সম্পাদিত সৈনিক’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যােগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে এর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও পরে বার্তা সম্পাদক পদে উন্নীত হন। ১৯৫৪ সালে আজাদ থেকে বেরিয়ে ঢাকাস্থ ইউ এস আই এস অফিসে জুনিয়র এডিটর হিসেবে যােগদান করেন। এক বছর পর তিনি ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। সিরাজ উদ্দিন হােসেন দীর্ঘদিন ইত্তেফাক এর বার্তা সম্পাদক থাকার পর ১৯৭০ সালে নির্বাহী সম্পাদক নিযুক্ত হন। আমাদের দেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মওলানা আকরম খাঁ, তােফাজ্জেল হােসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম হােসেন চৌধুরীর পর যার নাম বলতে হয়, তিনি শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন।  ইতিহাস বলে, ১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি, বুধবার দুপুরে ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা বাধিয়েছিলাে সে সময়ের কুখ্যাত গভর্নর মােনেম খাঁ, তাতে সায় দিয়েছিলাে পাকিস্তানের তৎকালীন যােগাযােগ মন্ত্রী খান আব্দুর সবুর ও আইয়ুব খানের চামচা কিছু বাঙালি। এর কারণ হচ্ছে- আইয়ুবের মিলিটারি শাসন তখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সে সময় মানুষের কোনাে গণতান্ত্রিক অধিকার একেবারেই ছিল না। ১৯৬২-৬৩ সালে বিচারপতি শরীফ ও বিচারপতি হামিদুর রহমানের শিক্ষানীতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন বেশ গরম, ১৯৬৪ সালেই মােনেম খাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভােকেশন করতে গেলে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবল প্রতিবাদ ও বাধার মুখে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করতে হয়।

সােজা কথায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গরম হওয়া মানেই পাকিস্তান সরকারের জন্য মহাবিপদ। অতএব মানুষের চোখ ও মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যই পাকিস্তান সরকারের প্রয়ােজন হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাের মতাে একটা জঘন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই দাঙ্গার ফলে ঢাকার লক্ষ্মীপুর, সূত্রাপুর এলাকায় হিন্দু বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, বাঙালি বিরােধী ও যড়যন্ত্রকারীদের তৈরি এই দাঙ্গা করতে একজন প্রগতিশীল সমাজকর্মী আমীর হােসেন চৌধুরীকে নওয়াবপুরে দাঙ্গাবাজ বাঙালি ও অবাঙালিদের হাতে জীবন দিতে হয়েছিল। সেই দাঙ্গা ছিলাে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের সচেতন সাংবাদিকরা এক জরুরি গােপন বৈঠক করলেন, ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় একটাই হেডিং হবে ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। ১৯৬৪ সালের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান দেখেছে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের কী অসহায় অবস্থা। পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে বিপদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য গিয়ে উদ্ধার করবে- এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এই অঞ্চলে শক্তিশালী ডিফেন্সই গড়তে দেয়া হয়নি। এ সবেরই ফলস্বরূপ। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর ভয়াবহ গণআন্দোলনে এবং ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাতের আগে বাঙালি কেমন স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সেই সময় স্বাধীনতার পক্ষের সংবাদপত্রগুলো কী সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন এবং সাংবাদিক হিসেবে যে কজন সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছিলেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন। এর আগে ১৯৬৬ সালে আইয়ুব খাঁনের শাসনামলে ‘ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে গেলে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন সংবাদ প্রতিষ্ঠান পি পি আই-এর ব্যুরাে চিফ নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ইত্তেফাক পুনরায় প্রকাশিত হলে তিনি পিপি আই থেকে ইত্তেফাকে ফিরে আসেন। পাকিস্তান শাসকরা এতাে সহজেই সিরাজ উদ্দিন হােসেনের ভূমিকার কথা ভুলে যায়নি। আর যায়নি বলে ডিসেম্বর মাসে মূলযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে সিরাজ উদ্দিন হােসেনকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেল। না তিনি আর ফিরে আসেননি। তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি।

মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সব ধরনের শােষণ-নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের কথা তুলে ধরার কাজে

নিয়ােজিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী বেগম নূরজাহান সিরাজীর ‘আমার স্বামী’ নামের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, মূলযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর ৫ নম্বর চামেলীবাগ বাসাটি হয়ে উঠেছিলাে যেন একটা তথ্যকেন্দ্র। সারাদিন লােকজন আসছে, গােপন খবরাখবর দেয়ানেয়া হচ্ছে। ঘরে হয়তাে চাল নেই, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের তিনি ঠিকই টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করছেন, তাদের যুদ্ধে যাবার ব্যবস্থা করছেন, বাড়িতে আশ্রয় দিচ্ছেন। নামকরা সাংবাদিক বলেই আশেপাশের লােকজন আসতাে যুদ্ধের সর্বশেষ খবর ও আশার বাণী শুনতে। এতাে কিছুর মধ্যেও তিনি ইত্তেফাকে যেতেন, যতােটা সংবাদপত্রের কাজ, তার চেয়ে বেশি যুদ্ধের সর্বশেষ খবর জানাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের সঠিক পরামর্শ দিতাে। সে সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাহেব তাকে ভারতে চলে যাবার অনুরােধ করে খবর পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন, সবাই চলে গেলে দেশের খবর কে দেবে? তিনি যাননি। সবশেষে তিনি যেতে রাজি হলেন ১০ ডিসেম্বর, বাসা ছেড়ে চলে যাবেন। তৈরিও হয়েছিলেন, কিন্তু ঠিক সেদিনই তাঁর এক বােন সপরিবারে তাঁর বাসায় এসে আশ্রয় নিলে তাঁর আর যাওয়া হলাে না। ১০ ডিসেম্বর শেষ রাতই শেষ রাত। রাত সাড়ে তিনটের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর ও রাজাকার বাহিনী বর্বররা তাঁকে তাঁর চামেলীবাগের বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে তাঁর চোখ-মুখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তখন তাঁর পরনে শুধু লুঙ্গি আর গেঞ্জি। ঘাতকরা তাঁকে জামা গায়ে দেবারও সুযােগ দেয়নি। আর ফিরে এলেন না শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন সৎ নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত। তিনি “শিশু অপহরণ সম্পর্কে’ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখে, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট অ্যাওয়ার্ড (আইপিআই) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পুরস্কার লাভ করেন। তাছাড়াও একুশে পদক লাভ করেন। শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হােসেন সত্যনিষ্ঠ ও সত্যাদর্শে নিবেদিত থেকে আমাদের দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : ইতিহাস কথা কও’, ‘ছােট থেকে বড়াে’; ‘মহিয়সী নারী; “বীর ও বীরঙ্গনা; A look into the mirror ইত্যাদি। তাঁর অনুদিত গ্রন্থ : জার্মান রূপকথা; ‘পারমাণবিক শক্তি রহস্য; আমার জীবন দর্শন; মানবজীবন; অগ্নিপরীক্ষা ইত্যাদি। তাঁর অনুদিত পুস্তকের সংখ্যা চল্লিশেরও অধিক।

মন্তব্য: