1. স্মরণীয় বরণীয়

আফসার উদ্দীন (১৯৩০ – ২০০২)

কবি আফসার উদ্দীন ১৯৩০ সালে (বাংলা ১৩৩৬ সাল ২ শ্রাবণ, বুধবার) মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন আমলসার গ্রামের এক কৃষকপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আল্লেখ মণ্ডল ও মাতার নাম সান্তষী খাতুন। বাল্যকাল থেকেই সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। পনেরাে/ষােল বছর বয়স পর্যন্ত কবি নিরােগ ছিলেন। কবির পিতার মৃত্যুর পর কবি লেখাপড়া বন্ধ করে স্কুলজীবন সমাপ্ত করেন। কিন্তু সাহিত্য সাধনার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকায় নিজ চেষ্টায় প্রচুর পড়াশুনা করেন। নিদারুণ অর্থকষ্টের মাঝে দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়েন কবি। তখন থেকেই কবি আফসার উদ্দীনের কবিতা লেখার হাতেখড়ি। মায়ের মৃত্যুর পর  কবি আফসার উদ্দীন একেবারে একা ও নিঃসহায় হয়ে দুঃখ-কষ্টের শিকারে পরিণত হন। কবি বাল্যকাল থেকেই পালাগান ও কবিতা রচনায় উৎসাহী ছিলেন। ১৯৫২ সালের সূচনালগ্ন থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কবি প্রচুর কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষাআন্দোলনের উপর অনেক কবিতা ও গান লেখার

মাধ্যমে কবি জসীমউদ্দীন-এর সাথে পরিচয় ঘটে। কবিতা লিখে কবি জসীমউদ্দীন-এর নিকট পাঠান। বলা যায় তাঁর উৎসাহে কবি আফসার উদ্দীনের সাহিত্যিক জীবনের সূচিত হয়। কবিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আনিয়া ভর্তি করান হল।  ডা: শামসুদ্দিন আহম্মদ সাহেবের অধীনে তাকে অতি যত্নের সাথে প্রায় ছয়মাস চিকিৎসা করা হলো। বিশেষ কোনো ফল হলো না। অসুখের নাম নিউরােল জিয়া। হাসপাতালে বসে তিনি কবিতা লিখে জসীমউদদীনকে পড়ে শোনাতেন। জসীমউদদীন আফসারকে উদ্দীনকে হাসপাতালে  দেখার জন্য আরও অনেক লেখককে অনুরােধ করতেন। হাসপাতাল হতে আফসার উদ্দীনকে গ্রামে নেওয়া হলো। তিনি জসীম উদদীনকে তার অন্তত একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছা জানালেন। আফসারের পত্র ও তার একটি কবিতা প্রাদেশিক লেখকসংঘের অফিসে তিনি পাঠালেন। আরো অনুরোধ করলেন সেইসঙ্গে অনুরােধ করলেন, আফসারের চিকিৎসার জন্য যেন তাকে কিছু অর্থ সাহায্য করা হয়। কিনতু কোন ফল হয় নি।

পূর্বদেশ কাগজে আফসার উদ্দীনকে নিয়ে জসীম উদদীন প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর লেখকসংঘ আফসার উদ্দীনের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করে। তাঁদের উদ্যোগে করাচি থেকে পাকিস্তানের বিশিষ্ট স্নায়ুরােগ বিশেষজ্ঞ ডা. জুম্মা খানকে ঢাকায় এনে আফসার উদ্দীনকে দেখান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাতেও তিনি রােগমুক্ত হতে পারেননি। চিকিৎসার জন্যে তাঁকে দীর্ঘদিন ঢাকার মেডিকেল, মিডফোর্ড হাসপাতালে কাটাতে হয়। তবুও কবির ভাগ্যে আরােগ্য লাভ ঘটেনি। দেশ স্বাধীন হলে পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার কবিকে মাসিক ভাতা দিতেন। কবি ঢাকা বেতারের একজন তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন-এর মৃত্যুর পর থেকে সকল প্রকার সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তারপর ঢাকা থেকে নিজগ্রামের বাড়িতে এসে বসবাস করতেন। এ সময় তাঁর বসবার বা স্বেচ্ছায় পাশ

ফিরে শােবার ক্ষমতাও লােপ পায়। তখন কেউ ঠেস দিয়ে বসিয়ে জলচৌকিরওপর কাগজ রেখে তার ওপর হাত তুলে দিয়ে আঙ্গুলের মধ্যে কলম ধরিয়ে দিলেই মাত্র লিখতে পারতেন। এই অবস্থায়ই তাঁর সাহিত্য সাধনা ও স্ব-শিক্ষা চলতে থাকে। তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ব্যাকরণ, অভিধান ও প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকগণের রচনাবলী ব্যাপকভাবে পড়াশুনা করেছেন। কবি আফসার উদ্দীনকে আক্ষরিক অর্থেই কিছু সহায়তা করবার জন্যে শ্রীপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছিল ‘কবি আফসার উদ্দীন সহায়ক সমিতি’। যার সম্পাদক ছিলেন শ্রীপুর অঞ্চলের কৃতিসন্তান সাচিলাপুর হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব কাজী ফয়জুর রহমান সাহেব। কবি জসীমউদ্দীন সাহেবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবি আফসার উদ্দীন সাহেবের আর্থিক সহযােগিতায় যেসব কৃতিসন্তান এগিয়ে আসনে তাঁরা হলেন : শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল মুহম্মদ আব্দুর রশীদ, শ্রীপুর এম.সি হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মােঃ আব্দুর রহিম জোয়ারদার, আমতৈল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুল হালিম, রাধানগর দ্বিমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুস সাত্তার মােল্যা, সােনাতুন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস হােসেন মােল্যা, মাগুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক আলহাজ্ব আব্দুল বারী মিয়াসহ নাম না জানা আরাে অনেকে।

চিরকুমার এই কবি তার এক পালিত কন্যা জামাতার সাথে অতিশয় দরিদ্র জীবন-যাপন করেছিলেন। বলা যায়, সে সময় কবি বিভিন্ন ব্যক্তির আর্থিক সহযােগিতায় এবং কৃষি আয়ের উপর শেষ জীবনের দিনগুলাে অতিবাহিত করেন।

কবি তাঁর সংগ্রামজীবনে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান দিয়ে প্রায় ৬০টির মতাে গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। কবির প্রকাশিত গ্রন্থাবলী : ‘একটি ফুল একটি জীবন’ (কাব্য); ‘চলন্ত পৃথিবী’ (উপন্যাস)’, ‘ভালবাস বেঁচে আছে’ (কাব্য); ‘হাসপাতালের ডায়েরি’ (স্মৃতিকথা-১৯৮৯)। কবির অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলী: ‘আমার স্বদেশ’ (কাব্য); “সূর্যপাখী’ (কাব্য); অনেক দিগন্ত’ (কাব্য); ‘খুকুর নাম হাসি (কাব্য); ‘প্রেমের পরশ’ (নাটক); কবি জসীমউদদীন (নাটক); ‘সতীনের মেয়ে’ (উপন্যাস); ‘ফুটন্ত যৌবন(উপন্যাস); ‘শেষের মিলন’ (উপন্যাস); চাপা’ (কাহিনীকাব্য); ‘ছায়া’ (কাহিনীকাব্য); ‘জীবনের স্মৃতি কথা’ (আত্মকথা); ‘দেখা হলে প্রাণ জুড়ায়’ (গানের বই); গড়াই নদীর পাড়ে ও এই না নদীর পাড়ে (গানের বই) ইত্যাদি। কবি আফসার উদ্দীন ১২ আগস্ট, ২০০২ সালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর অনেক কবিতা, গল্প, গান, এ দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।

মন্তব্য: