1. সদর

মাগুরা সদর উপজেলার পুকুর, খাল, বিল, বাওড়, নদী ও লোকাচার

পুকুরসমূহ

মহকুমা স্থাপিত হওয়ার পর মিঃ ককবার্ন মাগুরার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন। তখন মাগুরা এলাকায় সামান্য উঁচু এক অংশে হাট বসতো এবং বাকি অংশে ছিল গ্রাম। ককবার্ন গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে অন্যত্র হাট বসানোর আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বেশ ক’টি পুকুর খনন করিয়ে মাগুরা সদর উঁচু করলেন। পুকুরগুলোর অস্তিত্ব এখনও দেখা যায়। পুকুরগুলোর অধিকাংশ নতুনবাজার ও জেলাপাড়া এলাকায় দেখা যায়। মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মাগুরা সরকারী মহিলা কলেজ প্রাঙ্গনেও একটি বড় পুকুর রয়েছে। বর্তমানে উপরোক্ত এলাকার অনেকগুলো পুকুর ভরাট করে তৈরী করা হয়েছে বড় বড় ইমারত ও মার্কেট।  এছাড়া ইছাখাদার হযরত পীর মোর্করম আলী শাহ (রহঃ) এর মাজার ও দরগা শরীফ সীমানায় পীর কর্ত্তৃক খননকৃত দু’টি পুকুর এবং আলোকদিয়ার সৈয়দ শাহ পীর কালানদার এর দরবার শরীফ সীমানায় একটি পুকুর রয়েছে। এই তিনটি পুকুরকে কেন্দ্র করে মহান এই দুই পীর সাহেবের অনেক অলৌকিক কাহিনী লোক মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নিয়ন পরিষদ সংলগ্ন পুকুরটি সেনদের শাসনামলে খননকৃত। পুকুরটি তার মহিমা এখনও ধরে রেখেছে। 

তদুপরি, এখনও মাগুরায় যে পরিমান পুকুর, বিল, নদী, হাওড় ও বাওড় দেখা যায় তাতেই প্রমানিত হয় যে অতীতে এখানে আরো ব্যপক সংখ্যক জলাশয় ছিল।  

বিলসমূহ

মাগুরা সদর উপজেলার আঠারখাদা ইউনিয়নের আঠারখাদ গ্রামে রয়েছে রূপদাহ বিল নামে একটি বিল এবং নালিয়ারডাঙ্গী গ্রামে রয়েছে পুটোল বিল নামে একটি বিল। 

কছুন্দি ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামে রয়েছে গন্দমখোলা বিল এবং বেলনগর ও মাগুরা পৌর এলাকার বরুনাতৈল গ্রামে রয়েছে ঘুগরোর বিলের বৃহৎ অংশ আর কিছু অংশ রয়েছে বগিয়া ইউনিয়নের বারাশিয়া বারাশিয়া গ্রাম এলাকায়। এই দুই বিলের মাঝখানে ছোটবিল নামে আর একটি বিল রয়েছে। কথিত আছে ঘুগরো নামে এক ব্যাক্তি বিলের দক্ষিণ পাড়ে তাল গাছের ভিটায় বাস করতো। চলাচল করার জন্য তার নিজস্ব নৌকা ছিল। তার নাম অনুসারেই ঘুগরোর বিলের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বগিয়া ইউনিয়নের আলোকদিয়া ও পুখরিয়া গ্রামে রয়েছে চাপাদার বিল, বারাশিয়া গ্রামে রয়েছে সোনাইকুড়ি বিল, কালিগাং বিল, বড়কুড় বিল ও কানাপুকুর বিল। পদ্মবিল, বেরোইল বিল, দক্ষিণ মির্জাপুর বিল রাঘবদাইড় ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য বিল। 

মঘী ইউনিয়নের দক্ষিণ নওয়াপড়া গ্রামের  দক্ষিণ নওয়াপাড়া বিল, আন্দোলবাড়িয়া গ্রামের কুল্লের বিল, বুধোইর পাড়া গ্রামের শিকদার বিল, মাজগ্রাম এর পাকার বিল, বুধোইর পাড়া বোয়ালের বিল, বীরপুর গ্রামের বীরপুর বিল, কাপালীডাঙ্গা দীঘের বিল, ভাবনহাটি গ্রামের ভাবনহাটির বিল, কাপাসাটি গ্রামের ছোটবিল, কামারপাড়া গ্রামের কামারপাড়া বিল, আড়–য়াকান্দি গ্রামের নলডাঙ্গা বিল, মহিষাডাঙ্গা গ্রামের কুবলার বিল, খানাবাড়িয়া বারেঙ্গা বিল, মাজগ্রাম এর সোনাইকুড়ি বিল এবং বিষ্ণপু ও নিধিপুর গ্রামের বিষ্ণপুর বিল উল্লেখযোগ্য। 

জগদল ইউনিয়নের জাগলা, আজমপুর ও লক্ষীপুর গ্রামের টেটোর বিল, জগদল ও আজমপুর গ্রামের আলমার গাড়ি বিল, জগদল ও শ্যামপুরের তারাগাড়ের বিল, বিল আকছি বিল, নরসিংহাটি, শিমুলিয়া ও রায়গ্রাম এর কুমড়ার বিল, জগদল গ্রামের মুচিখালী বিল ও বকচর বিল তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। 

চাউলিয়া ইউনিয়নের ধলহরা, বারোইখালী, আরাজী শ্রীকুন্ডি ও মালিকগ্রামে অবস্থিত পদ্মবিলটি পদ্মনগর নামক স্থানে। বিলটিতে প্রচুর পরিমান পদ্ম ফুল ফুটতো। যার নামানুসারেই পদ্মবিলের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া এই ইউনিয়নে চাঁদপুর গ্রামে বাদের বিল ও চাঁদপুর, মালিকগ্রাম, নিশ্চিন্তপুর ও কুখিলা গ্রামে নগর বিল নামে আরো দুইটি বিল রয়েছে।

শত্রæজিৎপুর ইউনিয়নের ছেওস বিল জগদল, সিংহডাঙ্গা ও রূপদাহ গ্রামের মাঝে অবস্থিত। এখানে পানি ছেচে মাছ ধরার কারণে বিলটির নামকরণ হয়েছে ছেওস বিল।বনগ্রাম ও রূপদাহ গ্রামের মাঝে অবস্থিত শৈলকুপার বিল। এই বিলে শৈল মাছের আধিক্য রয়েছে। এই মাছ যুতি ও কোচ দিয়ে কুপিয়ে ধরা হয় বলে বিলটির নাম হয়েছে শৈলকুপা বিল। ফাদলের বিলটি রূপদাহ, ফাজিলা ও ঘোড়ানাচ গ্রামের মাঝে অবস্থিত। কচুগাড়ের বিল রূপদাহ ও ধর্মদাহ গ্রামের মাঝে অবস্থিত। কচু সদৃশ আগাছার আধিক্যের কারণে বিলটির নাম কচুগাড়ে     বিল। কালুপাড়ার বিলটি কালুপাড়া ও শত্রæজিৎপুর গ্রামের মাঝে অবস্থিত।

বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের কান্ডবাসা বিল চেঙ্গারডাঙা ও ডহর সিংহড়া গ্রামের মাঝখানে, রুইয়ের বিল নলোনগর গ্রামে , পুকুরের বিল ডহরসিংড়া ও বেরোইলের মাঝখানে (বর্তমানে ঘের করা হয়েছে), বাগমারা বিল বেরোইল গ্রামের পশ্চিমে ও পুটিয়া বিল পুটিয়া গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত।

কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের বুরাইল বিল  আমুড়য়া, কুল্লিয়া, কুচিয়ামোড়া, উত্তর ধর্মসীমা, আসবা, বড়শলই, শ্রীকান্তপুর ও বাটিকাবাড়ি গ্রাম জুড়ে অবস্থিত। মাগুরা সদর থানার সবচেয়ে বড় বিল। এই বিলে দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে আমুড়িয়া গ্রামের ধানখোলা বিল, আলমারগাড়ি বিল, বান্ধা বিল, ছোট বিল ও চাউলিয়া বিল, কুল্লিয়া গ্রামের গজারগাড়ি বিল ও তালগাছি বিল, বাকা হরিশপুর গ্রামের ঠাকুরের বিল, নাওখালী ও নুতনগ্রাম এর নাওখালী বিল।

গোপালগ্রাম ইউনিয়নে তাড়োরা গ্রামে রয়েছে পদ্মবিল ও বটতলার বিল, ধনের গাড়ি বিল (বটতলা বিলের সাথেই) এবং  গজার গাড়ে বিল। গোপালগ্রামের এই বিল অতিরিক্ত গভীর হওয়ার কারণে এই বিলে প্রচুর পরিমানে গজার মাছ লুকিয়ে থাকতো)। গোপালগ্রাম ও শ্যানের চর গ্রাম জুড়ে রয়েছে রুইয়ের বিল, সংকোচখালী গ্রামে রয়েছে বিল বাউড়ি ও ঘোল ডোবা বিল , বাহারবাগ গ্রাম জুড়ে রয়েছে ধানখোলা বিল ও তালগাছা বিল এবং শিয়ালজুড়ি গ্রামে রয়েছে দোবিলা বিল ও পুটি বিল।

খালসমূহ

মাগুরা সদর উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের হাজীপুর খাল ও নারায়নখালী খাল দুইটি নবগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। নারানখালী খাল পশ্চিমবাড়িয়ালা হয়ে নবগঙ্গা নদীতে নেমে গেছে। কছুন্দি ইউনিয়নে অবস্থিত মুচিখালী খাল ও ওয়াপদা খাল দুইটি মধুমতি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

বগিয়া ইউনিয়নের বারাশিয়া খাল¬টি বারাশিয়া বিল থেকে,  বরই খালটি বরই গ্রামের ভেতর দিয়ে, পুখরিয়া খালটি পুখরিয়া গ্রাম থেকে ও গৃহগ্রাম খালটি গৃহগ্রাম এর ভেতর দিয়ে নবগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। রাঘবদাইড় ইউনিয়নের দক্ষিণ মির্জাপুর খাল ফটকী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

মঘী ইউনিয়নের নওয়াপাড়া খাল ফটকি নদীতে মিশেছে, আন্দোলবাড়িয়া খাল আন্দোলবাড়িয়া থেকে ফটকি নদীতে মিশেছে, লস্করপুর খাল আন্দোলবাড়িয়ায় মিশেছে, বুধোইরপাড়া খাল বুধোইর পাড়া থেকে জাগলা হয়ে ফটকি নদীতে মিশেছে, তালতলা খাল কাপাসাটি থেকে ফটকি নদীতে মিশেছে, মহিষাডাঙ্গা খাল মহিষাডাঙ্গা থেকে উৎপত্তি হয়ে আড়ুয়াকান্দি, নলডাঙ্গা ও জাগলার মধ্য দিয়ে ফটকি নদীতে মিশেছে, জিয়ার হালি খাল ভাবনহাটির উত্তরে এবং ঝিনেইখালি খাল মঘীর দক্ষিণে  অবস্থিত। আগে চামচের পরিবর্তে ঝিনুকের খোসাকে চামচ হিসাবে ব্যবহার করা হতো। ঐ সমস্ত ঝিনুক এখানে ফেলার কারণে এই খালটির নামকরণ করা হয়েছে ঝিনেইখালি খাল।

জগদল ইউনিয়নের হাওড়খালী খাল হাওড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ফটকী নদীতে, শুমুরিয়া খাল  পদ্মবিল থেকে হাড়খালী খালে মিশেছে, গুয়েদা খাল বিল আকছি হয়ে হাওড়খালী খালে মিশেছে, নিশানখালী খাল কুমড়া বিল থেকে উৎপন্ন হয়ে বিল আকছিতে মিশেছে, তাতীর খাল বকচর বিল থেকে উৎপন্ন হয়ে আলমারিগাড়ি বিল হয়ে ফটকী নদীতে মিশেছে, লক্ষীপুর খাল টেটোর বিল থেকে নিধিপুর ও চাপড়া হয়ে ফটকী নদীতে পড়েছে, মলম ফকীরের খালটি রূপাটি গ্রামে অবস্থিত, ছকার খাল ছকাতুল্লা মোল্যার নামানুসারে হয়েছে।

চাউলিয়া ইউনিয়নের ভাটির খাল নগর বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে কুকিলা ও ঘোড়ানাচ হয়ে জগদল চলে গেছে, গোয়ালবাড়ি খাল বুজরুক শ্রীকুন্ডি ও মালিকগ্রাম, চাঁদপুর খাল চাঁদপুর বাওড় থেকে পদ্মবিলে চলে গেছে।   

শত্রæজিৎপুর ইউনিয়নের কচাতলার খাল পয়ারী মাঠ থেকে নবগঙ্গা নদীতে পতিত হয়েছে। ধ্যানোর খাল (প্রায় মৃত) বনগ্রাম বিল থেকে সিংহডাঙ্গার বিল পর্যন্ত বিস্তার। সিংহডাঙ্গার খাল ছেওস বিল থেকে মাছ মারার দোপ নামক স্থান পর্যন্ত বিস্তার। মছন্দারীর খাল রূপদাহ বিল থেকে শৈলকুপার বিল পর্যন্ত বিস্তার।

বেরোইল পলিতা ইউনিয়নের বাগমারা খাল বাগমারা বিল থেকে বেরোইলের মধ্য দিয়ে নবগঙ্গায় পতিত। দীঘলকান্দি থেকে কচুগাড়ে খাল নবগঙ্গায় পতিত। বেরোইল গ্রামে নাটাবাড়ে নামে একটি বড় খাল ছিল । এখন সেখানে জনবসতি হয়ে গেছে। এই খালে লঞ্চ ও স্টিমার চলতো।

কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের আমুড়িয়া গ্রামের বর্ণালী খাল ও চেঙ্গাইখালী খাল এবং কুচিয়ামোড়া গ্রামের বেতবাড়িয়া খাল ফটকী নদীর সাথের সংযোগ রয়েছে।

গোপালগ্রাম ইউনিয়নে রয়েছে দইসরা নামক একটি খাল। এর নামের সাথে রয়েছে একটি লোককাহিনী। সদারাম ঠাকুর উপরওয়ালার কাছে দই খেতে চেয়েছিলেন। তার বড় ভাই রাগ করে হাতে আঘাত করলে সদারাম বলে “দাদা বাড়ি দিয়ে দইয়ের হাড়ি ভেঙে ফেললে?” তখন লাঙলের ফলায় দই ভেসে যায়। তখন থেকে এই খালের নাম দই সারা খাল।

বাওড়

মাগুরা সদরের চাউলিয়া ইউনিয়নের সিরিজদিয়া গ্রামে রয়েছে বৃহৎ আকৃতির একটি বাওড়। বাওড়টি দেখতে চন্দ্রাকৃতির এই বাওড়ের এক পাড় ঘেষে চাঁদপুর গ্রাম। এলাকাবাসীর অভিমত ইংরেজ শাসনামলে এই বাওড়টিই ছিল নবগঙ্গার মূল জলরাশি। কোন এক ব্যক্তি মাছ ধরার জন্য নবগঙ্গার অল্প একটু পাড় কাটলে রাতারাতি নদীর পাড় ভেঙ্গে একটি বিকল্প ধারা তৈরী হয়। বর্তমানে সেই ধারাটিই মূল নদী হয়ে গেছে। আর বাওড়টি রূপ নেয় স্বতন্ত্র রূপে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নবগঙ্গার সাথে এর সংযোগ চর পড়ার ফলে। আর নতুন ধারাটি সিরিজদিয়া গ্রামকে দু’ভাগে দেশজ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি এই বাওড়ে  সিলভার কার্প, মৃণার কার্প, রুই, কাতলা, গ্রাস কার্প চাষ করা হয় সমবায় ভিত্তিতে। এই বাওড়টিতে ৬৩টি পরিবার সমবায় ভিত্তিতে মাছ চাষের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে।  এই বাওড়টি বনভোজনের জন্য একটি উপযুক্ত জায়গায় পরিনত হচ্ছে। এছাড়া বগিয়া ইউনিয়নের পুখরিয়া ও আলোকদিয়া গ্রাম জুড়ে একটি বাওড় রয়েছে। 

নদী

মাগুরা জেলা শহরটি নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। নবগঙ্গা নদীটি চুয়াডাঙ্গা শহরের কাছে উৎপত্তি হয়েছে। পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে নদীটি মাগুরায় এসে কুমার নদের সাথে মিলিত হয়েছে এবং নড়াইলে চিত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তারপর নদীটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত ভৈরব নদের সাথে মিলিত হয়েছে।  মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমার নদের সাথে মিলিত হলে নবগঙ্গা নতুন জীবন লাভ করে। মূলত মাগুরার পরের নবগঙ্গা কুমার নদের বিস্তৃত রূপ। নবগঙ্গা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। মাগুরা পর্যন্ত এর গড় প্রস্থ ২০০ মিটার এবং মাগুরার পরের অংশে ৩০০ মিটার। চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বিনোদপুর, শত্রæজিৎপুর, বেরইল পলিতা, গঙ্গারামপুর, চাউলিয়া, নহাটা, বারাদিয়া, গাজিরহাট নবগঙ্গা তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থান। জেলার অন্যান্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে মধুমতি, কুমার, গড়াই, ফটকি ও ইছামতি। 

মাগুরা সদর উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নই কোন না কোন নদীর সংস্পর্শে রয়েছে। কছুন্দি ইউনিয়নের উত্তর-পশ্চিমে কুমার নদ এবং পূর্ব পাশে মধুমতি নদী প্রবাহিত। বগিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ পাশে নবগঙ্গা এবং পূর্বপাশে মধুমতি নদী প্রবাহিত। হাজরাপুর ইউনিয়নের উত্তরে প্রবাহিত নবগঙ্গা নদী। রাঘবদাইড় ইউনিয়নের দক্ষিণে ফটকী নদী মাগুরা সদর উপজেলা ও শালিখা উপজেলাকে পৃথক করেছে। মঘি ইউনিয়নের দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্বে কিছু অংশে ফটকি নদীর ছোঁয়া রয়েছে। চাউলিয়া ইউনিয়নের উত্তরে রয়েছে নবগঙ্গা নদী। নদীটি শত্রæজিৎপুর ইউনিয়নের উত্তর ও পূর্বদিক দিয়ে এবং বেরইল ইউনিয়নের পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত। ফটকী নদী কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের পশ্চিম হতে দক্ষিণপূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত। নবগঙ্গা নদী গোপালগ্রাম ইউনিয়নের পূর্বপাশ দিয়ে প্রবাহিত। 

উপরোক্ত জলাশয়সমূহকে ঘিরে অনেক লোক ঐতিহ্য, লোক কাহিনী, কিংবদন্তীর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সময়ের কালস্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো অনেক ঐতিহ্য। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও সেসব ঐতিহ্যকে ধরে রাখার কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় না। স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক লোকাচার। ঋতু বদলের কারণে এবং বর্ষাহীনতার কারণে মাগুরার অধিকাংশ জলাধার শুকিয়ে যায় শীত ও গ্রীষ্ম মৌসুমে।  জলাশয়গুলোর পূর্ণ অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় শুধু বর্ষা মৌসুমেই । অনেক খাল, বিল, নদী ও বাওড়ে এখন হাইব্রীড জাতের ধান, পাট ও বিভিন্ন রবি শস্য উৎপাদিত হয়। 

নদী, খাল ও বিলেরগুলোর সাথে মানুষের রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। তেমনই সম্পর্ক রয়েছে মাগুরা অঞ্চলের লোকজ ধর্ম, জীবন জীবিকা, লোকজ যানবহন ও লোকজ সংস্কৃতির সাথে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে দেখা যায়, ভোরে নদীতে স্নান করতে গিয়ে বুক সমান পানিতে দাড়িয়ে সূর্যকে প্রণাম করতে। এটি আমাদের লোকজ ধর্মেরই একটি অংশ। এছাড়া বিভিন্ন পূজা শেষে প্রতিমাকে নদীতেই বিসর্জন দেওয়ার রীতি রয়েছে। এছাড়া নদীকে কেন্দ্র করে যে পূজাটি উৎসবে পরিনত হয় মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং লোকজ মেলা বসে তা হলো গঙ্গাস্নান ও গঙ্গাদেবী পূজা।

পুকুর, খাল, নদী ও বিলের সাথে যে লোকজ খাবারের সম্পর্ক রয়েছে তা হলো শালুক এবং শাপলা ফুলের নাইল। কিশোর-কিশোরীরা এসব জলাশয় থেকে শালুক তুলে সেগুলো পুড়িয়ে তৃপ্তির সাথে আহার করে। এছাড়া শাপলা ফুলের নাইল গ্রাম এলাকায় সবজি হিসাবে বেশ সুস্বাদু করে রান্না করা হয়। 

লোকযান এর সাথেও রয়েছে খাল, বিল ও নদীর এক অপূর্ব সমন্বয়। গুন টেনে নৌকা বেয়ে নিয়ে যাওয়া, কিংবা  নববিবাহিত রমনী-পুরুষদেরকে বয়ে নেওয়া নৌকা লোকজ সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। তাছাড়া নৌকায় করে জেলের জাল ফেলার দৃশ্যটি বেশ মুগ্ধকর। জীবন-যাত্রার একটি অংশ হলেও বর্ষার সময় কলাগাছের ভেলায় চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া অনেকের জন্য বেশ রোমাঞ্চকর। ডুঙ্গায় কিংবা ভেলায় চড়ে বড়শি ফেলে মাছ ধরার দৃশ্যটি কেবল গ্রামীণ নদী, খাল ও বিলেই দেখা যায়। আর মাগুরা অঞ্চলে এসব দৃশ্য খুবই পরিচিত। 

মাগুরা অঞ্চলের জলাশয়গুলো মালো ও রাজবংশি (জেলে) সম্প্রদায়ের জন্য জীবিকা অর্জনের একমাত্র মাধ্যম। বিভিন্ন পুকুর ও বাওড়ে বিদেশি প্রজাতির মাছের চাষ হলেও খাল, বিল ও নদীতে পাওয়া যায় দেশী জাতের মাছ।  দেশি মাছের মধ্যে রয়েছে পুটি, টাকি, টেংরা, রয়না, চান্দা, চিংড়ি, শৈল, গজার, পাবদা, শিং, মাগুর, কৈ প্রভৃতি। এসব মাছ জেলেরা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে নিজেদের পরিবারের আহার যোগায়। এছাড়াও নদী ও খালের সাথে সম্পর্ক রয়েছে মাঝি সম্প্রদায়ের। নৌকাযোগে মানুষকে নদী ও খাল পার করে অর্জিত অর্থ পরিবারের ভরণপোষন চালিয়ে থাকে। তবে অনেক নদীতে সেতু হওয়ার কারণে অনেক মাঝি তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে।  

নদীপথে নৌকাযোগে মাগুরা অঞ্চলে উৎপন্ন কৃষি পণ্য বিশেষ করে ধান, পাট, সবজি ও রবিশস্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় আনানেওয়া করা হয়। মাগুরার সাথে  নদীপথে যোগাযোগ রয়েছে ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল, রাজবাড়ি ও ঝিনাইদহ জেলার। কৃষি পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি মৃতশিল্পের এবং বাঁশ ও বেত শিল্পের বিভিন্ন সামগ্রিও বহন করা হয় নদীপথে।  

নদী, খাল ও বিলে প্রাপ্ত শামুক ও ঝিনুক প্রক্রিয়াজাত করে তৈরী করা হয় বিভিন্ন খেলনা ও অলংকার। ফলে এটিও অনেক পরিবারের আয়ের উৎসে পরিনত হয়েছে। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাত শামুক ও ঝিনুক হাস-মুরগীর খামারেও খাবার হিসাবে ব্যবহারের ফলে শিল্প ক্ষেত্রেও জলাশয়গুলো রেখে চলেছে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা। মাগুরার বিল, খাল ও নদীতে উৎপন্ন আখ সদৃশ ঘাস (মেলে) দ্বারা তৈরী হচ্ছে মেলে পাটি। অনেক ভূমিহীন দরিদ্র পরিবার মেলে পাটি তৈরী করে বিক্রির মাধ্যমে পরিবারের জন্য বয়ে এনেছে স্বাচ্ছন্দ। পাটিগুলো যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, রাজবাড়ি, ফরিদপুর এমনকি ঢাকায়ও বিক্রি হচ্ছে মেলে পাটি। মাগুরার কেচুয়াডুবি গ্রামের ১৮০টি পরিবার মেলেপাটি তৈরীর সাথে জড়িত রয়েছে। 

মাগুরা সদর উপজেলাটি নদীবেষ্টিত হওয়ার কারণে নৌকাবাইচ আয়োজনে জমজমাট হয়ে ওঠে বিভিন্ন অঞ্চল। নৌকাবাইচের জন্য জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বাইচের নৌকার সমারোহ ঘটে।  মাগুরা জেলার বাইরে থেকেও বাইচের নৌকা আসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্য।নৌকা বাইচের সময় সারিগান গাওয়া হয়।  গানের সাথে থাকে কাশি, বাঁশি ও ঝুমুর তালে তালে বৈঠা বইবার জন্য।  নৌকাবাইচে অংশগ্রহনকারী প্রতিটি দল স্বতন্ত্র দলীয় পোশাক পরিধান করে।  

জলাশয়ের স্বল্পতার কারণে নৌকাবাইচ এর আয়োজন কমে গেলেও এখনও মাগুরা সদরসহ শালিখা, শ্রীপুর, মহম্মদপুর উপজেলায় নদীগুলোতে নৌকাবাইচের আসর বসে। অনুষ্ঠিত হয় লোকজ মেলা। মাগুরা সদরের চাউলিয়া ইউনিয়নের সিরিজদিয়া বাওড়ে সাঁতার প্রতিযোগিতা ও নৌকাবাইচ অনুষ্টিত হয়। বেরোইল পলিতা গ্রামে নবগঙ্গা নদীতে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। কুচিয়মোড়ার নবমীর মেলায় নৌকাবাইচ হয় ফটকী নদীতে।

তথ্যপ্রদানকারীঃ 

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, চেয়ারম্যান, কুচিয়ামোড়া ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা 

খন্দকার মহব্বত আলী,  চেয়ারম্যান, বেরোইল পলিতা ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা

স্বপন ভট্রাচার্য, পুরোহিত, শত্রæজিৎপুর শ্মশান আশ্রম

মোঃ.কেছমত আলী ও মোঃ ছেকেন্দার আলী, সদস্য চাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ অলিয়ার রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জগদল ইউনিয়ন পরিষদ 

আঃ লতিফ বিশ্বাস, চেয়ারম্যান, মঘী ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ বকুল মুন্সী (৬০), দক্ষিণ মির্জাপুর, গ্রামপুলিশ

মোঃ রেজাউল করিম, প্রাক্তন ইউপি মেম্বর, হাজরাপুর ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ খবির আহমেদ, সচিব, কছুন্দি ইউনিয়ন পরিষদ

মন্তব্য: