1. স্মরণীয় বরণীয়

সৈয়দ আলী আশরাফ(১৯২৪- ১৯৯৮)

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ, কবি, সমালােচক, সুফি, সংগঠক, মানবসেবী ও ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলাধীন আগলা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরাে নাম সৈয়দ আবু নছর আলী আশরাফ। তবে আলী আশরাফ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আলী হামেদ ও মাতার নাম সৈয়দা কামরুন্নিগার খাতুন। তার পৈত্রিক নিবাস মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন আলােকদিয়া গ্রামে। ঢাকা মিরপুরের মাজারে শায়িত বিখ্যাত সুফি সাধক ও ইসলাম প্রচারক হযরত সৈয়দ শাহ আলী বাগদাদী (রা:) তাঁর পূর্বপুরুষ। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ শাহ আলী বাগদাদী বংশানুক্রমে রাসূল (সা:)-এর দৌহিত্র ইমাম হােসাইন (রা:)-এর ১৯তম পুরুষ। তিনি সুদূর বাগদাদ থেকে সুফি সাধনা প্রসার ও ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চল্লিশ (৪০) জন সঙ্গী নিয়ে ১৪৪৩ সালে ভারতের দিল্লীতে আসেন। সৈয়দ শাহ আলী বাগদাদী (রা:) স্ত্রী ও পুত্র সৈয়দ শাহ ওসমানকে নিয়ে ১৪৫১ সালে ফরিদপুরের গােরদায় চলে আসেন। এখানে আসার পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও সন্তানাদি লাভ করেন।  সৈয়দ শাহ ওসমানের পুত্র ছিলেন সৈয়দ শাহ আঃ কাদির, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ আঃ রশিদ, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ মুহাম্মদ যাকের, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ মুহাম্মদ হাফিজ। এই সৈয়দ শাহ মুহাম্মদ হাফিজ গােরদা থেকে মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন আলােকদিয়া গ্রামে এসে বসবাস করেন। কবি সৈয়দ আলী আহসান,  প্রখ্যাত হােমিওপ্যাথিক অধ্যাপক সৈয়দ আলী রেজা, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও আলশেফা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকী ও এক সময়ের বাংলাশিক্ষক সৈয়দ আলী তকী সৈয়দ আলী আশরাফের ভাই। ইমাম হােসাইন (রাঃ)-এর বংশ তালিকায় সৈয়দ আলী আশরাফ ৩১তম পুরুষ।

সৈয়দ আলী আশরাফ ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।  ১৯৪০ আরমানীটোলা সরকারী ইংরেজি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে আই.এ পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে ইংরেজিতে বি.এ অনার্সে প্রথমশ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে উক্ত বিষয়ে এম.এ পাস করেন। পরবর্তীতে বৃটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযােগ লাভ করেন। ওখান থেকে ১৯৫২ সালে ইংরেজিতে বি.এ অনার্স পাস করে দেশে ফিরে আসেন। পুনরায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযােগ পান এবং ১৯৫৬ সালে ইংরেজিতে এম.এ ও ১৯৬৪ সালে English poetry and its audience বিষয়ে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান ছাত্রী ও পরবর্তীতে রােকেয়া হলের প্রথম প্রভােস্ট মরহুমা বেগম আছিয়া আশরাফ তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন। সৈয়দ আলী আশরাফ ও বেগম আছিয়া আশরাফ দাম্পত্যজীবনে কোনাে সন্তানাদি লাভ করেননি।

১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে তার শিক্ষকতাজীবন শুরু। ১৯৪৭-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির লেকচারার এবং রিডার ছিলেন। ১৯৫৫-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের রিডার এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ১৯৫৬-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির প্রফেসর এবং বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ১৯৭৩-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লেয়ার হলের ফেলাে ছিলেন। ১৯৭৪-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সৌদিআরবের জেদ্দাস্থ কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মক্কাস্থ উন্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ১৯৮২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। অবশেষে মৃত্যু পর্যন্ত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়ােজিত ছিলেন। তাছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে আমেরিকার হার্ভার্ড ও ১৯৭৪ সালে কানাডার নিউ ব্রান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। অন্যদিকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ কোর্সে লেকচার দিয়েছেন।

সৈয়দ আলী আশরাফ ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক।  তিনি “শিক্ষার ইসলামীকরণ’ একক শিক্ষাদর্শন নিয়ে সারা বিশ্বে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এবং শিক্ষা সংস্কারে পথিকৃত হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য সেকুলারিস্ট ধ্যান-ধারণার প্রভাবে যে নৈতিকতা ও মূল্যবােধের অবক্ষয় চলছে তা থেকে রক্ষা পেতে হলে শিক্ষার ইসলামীকরণ করে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার বিকল্প নেই। বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত শিক্ষাসম্মেলন, সেমিনার, ওয়ার্কসপ ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার ইসলামীকরণ আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে শিক্ষা সংস্কারে অতুলনীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে নিজদেশে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাঁর শিক্ষাদর্শনকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষা সংস্কারের কাজ চালু রেখে গেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান হিসেবে উল্লেখযোেগ্য সংখ্যক বই লিখে গেছেন। যা বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষভাবে সমাদৃত।

সৈয়দ আলী আশরাফ একজন খ্যাতিমান ধর্ম প্রচারক ছিলেন। ধর্ম প্রচারে তার মাধ্যম ছিল দু’টি। প্রথমত : শিক্ষার ইসলামীকরণ, দ্বিতীয় : সুফি সাধনা। শিক্ষার ইসলামীকরণে তিনি বিভিন্ন মত ও ধর্মাবলম্বীদের নিকট ইসলামী মূল্যবোধ ও আকিদায় বিশ্বাসের দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁর এ দাওয়াতি কাজ অত্যন্ত সুক্ষ্ম ৩ প্রজ্ঞার সাথে চালু রেখেছিলেন। অন্যদিকে তিনি একজন সুফি সাধক হিসেবে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান অলি-বুজুর্গদের খেলাফত লাভ করেন। তিনি সুফি সাধনায় আধ্যাত্মিকতার এক বিরাট পর্যায়ে উন্নতি লাভ

করেছিলেন। এসব দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন কামেল অলি। অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ নীরব সমাজকর্মী।  গ্রাম-গঞ্জে মাদরাসা-মসজিদসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও অন্যান্য কল্যাণ ও সেবাক্ষেত্রের মাধ্যমে সমাজের নির্ভীক কর্মী হিসেবে সামাজিক উন্নতি করে গেছেন। 

ইংরেজি এবং বাংলা সাহিত্যাংগনে তাঁর পরিচিতি চল্লিশের দশক থেকে। ১৯৪৩-৪৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সহসম্পাদক ছিলেন, ১৯৪৪-৪৫ সাল পর্যন্ত সম্পাদক ও ১৯৪৫-৪৭ সাল পর্যন্ত সহ-সভাপতি ছিলেন। কবি সাহিত্যিক হিসেবে তিনি বেশ সংখ্যক বই রচনা করে গেছেন।  তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশরাফ চেরিটেবল ট্রাস্ট ও জাকাত ফান্ড মানব সেবা ও দানকাজে এক অনন্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। নিঃসন্তান সৈয়দ আলী আশরাফ মৃত্যুর পূর্বে তার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি আশরাফ চেরিটেবল ট্রাস্ট ও দারুল ইহসান ট্রাস্টে দান করে গেছেন। ৭ আগস্ট ১৯৯৮ সালে বৃটেনের ক্যামব্রিজস্থ নিজবাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থ- কবিতা: চৈত্র যখন (১৯৫৭), বিসংগতি (১৯৭৪), হিজরত (১৯৮৪), রূপবাইয়াতে জহীনি (১৯৯১), প্রশ্নোত্তর (১৯৯৬)। অনুবাদ: ইভানকে ক্লেয়ার গল (অনুবাদ : ১৯৬০), প্রেমের কবিতা (সৈয়দ আলী আহসানের সাথে যৌথ)।

গদ্যগ্রন্থ: কাব্যপরিচয় (১৯৫৭), নজরুলজীবনে প্রেমের এক অধ্যায়, রূপ বাংলা (১৯৯৫), বাংলাসাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য (১৯৬২), সংসদ যুগ : পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের ইতিকথা, অন্বেষা (আধ্যাত্মিক জীবনের বর্ণনা), সাহিত্য বিচার, কাব্যসংকলন (১৯৬৭)

সৈয়দ আলী আশরাফের কবিতা (১৯৯১)। সম্পাদনা: দিলরুবা সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সম্পাদক।

মন্তব্য: