1. ইতিহাস
  2. মাগুরার সাহিত্যের কাগজ

মাগুরা সাহিত্য-আড্ডা ও ছোটকাগজ প্রসঙ্গ

শিকদার ওয়ালিউজ্জামান

লিটল ম্যাগাজিন আতুর ঘর থেকেই তারুণ্যের পতাকাবাহী। নতুন এবং প্রতিশ্রুতিশীল লিখিয়েদের বিকাশের প্রথম আশ্রয়। সৎ সাহিত্য ভাবনা ও সমাজ সৃষ্টির দিক-নির্দেশপত্র। লিটল ম্যাগ একটি সংগ্রাহাগার, অক্ষরের সমাবেশ আর চেতনার উন্মেষ। বাধানো বই বলে লিটল ম্যাগকে অনেকেই তাচ্ছিল্য করে থাকেন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই টি. এস. এলিয়টের বিখ্যাত ডধংঃব খধহফ এর প্রথম আশ্রয়স্থল ‘ডায়াল’ লিটল ম্যাগ। বড় মাপের কবি হোক, আর সাহিত্যিক হোক কোন না কোনভাবে লিটলম্যাগের সাথে তার সাহচর্য বা সখ্যতা থেকেই যায় বা গড়ে ওঠে। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক বা দৈনিক পত্রিকাগুলোতে গতানুগতিক সাহিত্য সাময়িকী  প্রকাশিত হয় । অনেক ক্ষেত্রে সেটা হয়ে ওঠে বানিজ্যিক পণ্য। এই পণ্যসর্বস্বতা থেকে রেহায় পেতে ব্যতিক্রম চিন্তা ও সৃজনশীল সাহিত্যকর্মিরা নতুন  নতুন প্রচেষ্টা, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে প্রকাশ করে থাকেন লিটল ম্যাগ। বহু ত্যাগের এই প্রকাশকে যদি কেউ শুধুমাত্র বাধানো বই বলে আখ্যায়িত করেন, তিনি বোকার জগতে বাস করেন। লিটল শব্দ দ্বারা আয়তনে ছোট-বড় বুঝানো নয় বরং কতটা বোধ, কতোটা নিরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত হলো সেটাই মুখ্য। এখানে ঢালাওভাবে কোন সমাবেশ থাকে না, থাকে না বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিও।  

আড্ডার মাধ্যমে বোঝা যায় নিজের শূন্যতা-গভীরতা। কতোটা পাঠাভ্যাসে আলোর সিঁড়িকে ছোঁয়া কিংবা কতোটা অভিজ্ঞতায় নিজেকে ঋদ্ধ করা হলো সেটা আড্ডার মাধ্যমেই প্রকাশ করা সম্ভব। অর্থাৎ নিজেকে জানার অনেকটাই নির্ভর করে আড্ডার উপর। আর যে কোন লিখিয়ের জন্য সাহিত্য-আড্ডা টনিকের কাজ করে তাদের উন্মেষকালে। ‘আড্ডায় সঞ্চয় কলমে অপচয়’ এটাইতো সাহিত্যিকের বড় পুঁজি। আড্ডাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক একটি গোষ্ঠি, মতবাদ। জন্ম নেয় একেকটি ছোটকাগজ। আবার আড্ডাবাজদের মতবিরোধের কারণে অচিরেই ভেঙে যায় সাহিত্যিকের মিলনমেলা। বন্ধ হয়ে যায় ছোটকাগজের প্রকাশনা। 

চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাট দশকে কাজী কাদের নেওয়াজ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, আজিজুল হক, ফররুখ আহমদ, ডাঃ লুৎফর রহমান  গোলাম রসুল, আফসার উদ্দীন এর পদচারণায় মাগুরা সমৃদ্ধ হলেও তেমন কোন সাহিত্য আড্ডা বা সাহিত্যের ছোট কাগজ প্রকাশ সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে সমস্ত ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো সেগুলোই সাহিত্যকর্ম প্রকাশের পরিচায়ক। তৎকালীন সময়ে মাগুরা এজি একাডেমী’র প্রধান শিক্ষক খান জিয়াউল হক সাহিত্যের বিকাশ ও শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। আবৃত্তিকার হিসাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক গুণী আবৃত্তিকারের। সম্প্রতি তিনি তার উজ্জল অতীতের জন্য নরেন বিশ্বাস স্মৃতি পদক লাভ করেছেন।   

সাত ও আট এর দশকে এক ঝাঁক লেখিয়ে মাগুরার সাহিত্যাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করেন। কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে করিম চিশতি, গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, চ-ি প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বি. এম. এ হালিম, মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু, রোমিও জালালি, বিবেকানন্দ মজুমদার, বিকাশ মজুমদার, ভোলানাথ সিকদার, সুশীল কুমার শিকদার, দাউদ হোসেন, জহুরুল ইসলাম,  পরিতোষ দত্ত, সিরাজুল করিম, কিশোর গোলদার, ডা. নাসিরুল ইসলাম, তপন কুমার তপু, এম এ হাকিম, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ এ সময়কে সাহিত্য চর্চা করেন। ১৯৭৫ সালে কবি-সাহিত্যিকগণ নবগঙ্গা সাহিত্য গোষ্ঠি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তিতে জেলা সাহিত্য পরিষদ, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ(মাগুরা শাখা) অনুপ্রাস সাহিত্য গোষ্ঠি, লুৎফর রহমান একাডেমী’র আতœপ্রকাশ ঘটে। বি এম এ হালিম এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘নবগঙ্গা’ সাহিত্যের কাগজ। ‘নবগঙ্গা’র নয়টি সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন ঔপন্যাসিক দাউদ হোসেন। পরবর্তিতে বি এম এ হালিম অনিয়মিতভাবে কাগজটি প্রকাশ করে আসছেন। ১৯৭৭ সালে অনিল দে মনি’র সম্পাদনায় ‘বর্ণালী’, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র ‘আমরা বারোজন’। দাউদ হোসেন এর সম্পাদনায় ১৯৮৭ সালে ‘সময়’, ১৯৮৯ সালে ‘অনুপ্রাস’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘ঈক্ষণ’ নামে একটি কাগজ সম্পাদনা করেন শামসুজ্জামান পান্না। তার সম্পাদনায় ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর বর্ধিত কলেবরে ‘ঈক্ষণ’ সম্পাদনা করেন রোমিও জালালী। আট এর দশকে আরো কয়েকটি কাগজের মধ্যে রয়েছে সুশীল শিকদার সম্পাদিত ‘অনাদৃতা’, রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘চেতনা’, মাসুদুর রহমান সম্পাদিত ‘হাতিয়ার’, মিয়া ওয়াহিদ কামালু সম্পাদিত ‘জীবন আজীবন’ ও রোস্তম মল্লিক সম্পাদিত ‘প্রভাতি’ ও ‘চয়ন’।  মাগুরার সাহিত্য ও লিটল ম্যাগ চর্চার ক্ষেত্রে সপ্তক সাহিত্য চক্র’র বিভিন্ন সময়ের আড্ডার সারসংক্ষেপ নিম্নবর্ণিত আলোচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করছিÑ

লিটলম্যাগ বিষয়ক মুক্ত আড্ডার ধারণকৃত অংশ থেকে… 

মাগুরায় সাহিত্য চর্চার একাল -সেকাল ( বিকাশ মজুমদার) 

মাগুরায় সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ বেশ পুরাতন। আমার জানা মতে স্বাধীনতা পূর্বকালীন সময়ে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিশেষ করে মাগুরা এজি একাডেমী, মাগুরা সরকারী বালক বিদ্যালয় থেকে ম্যাগাজিন বের হতো।  সংগঠিতভাবে লিটলম্যাগ প্রকাশনা স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালীন সময়ে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে গুটি কয়েক সাহিত্যের কাগজ প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালের পর থেকে সংগঠিত হয়ে অনেক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। নবগঙ্গা সাহিত্য গোষ্ঠি ,‘নবগঙ্গা’ উদীচী(মাগুরা শাখা) ‘উদীচী’ নামে সাহিত্যের কাগজ করতো। এগুলোর সম্পাদনা করেন ভোলানাথ শিকদার, বিশ্বাস স্বপন ও রূপক আইচ।  নব্বইয়ের দশক ও শূন্যের দশকে বেশ কিছু সংগঠনের আতœপ্রকাশ ঘটে। আবার বিলুপ্তও হয়ে গেছে। তবে অধিকাংশ সংগঠন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। নব্বইয়ে নির্মাণ সাহিত্য সংসদ, কাদের নেওয়াজ সাহিত্য সংসদ ও লেখক জোট সংগঠন হিসাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করলেও বর্তমানে এদের কোনপ্রকার কর্মকা- নেই। এ সময় ইব্রাহীম আলী মোনাল ও মনির-উজ-জামান, সাগর জামান পুরো দশকেই অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে সাহিত্যাঙ্গনকে মুখর করে রেখেছে। এ সময়ে ইব্রাহীম আলী মোনাল বেশ কয়েকটি কাগজ সম্পাদনা করেন। তার মধ্যে ‘স্রোতস্বিনী’, ’নির্মাণ’ ও ’বনফুল’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল। নববইয়ের শেষের দিকে নবীন ও প্রবীন কবি-সাহিত্যিকরা মিলে জোটবদ্ধ হয়ে ডিসি কোর্টের উকিল বারে প্রতি শুক্রবার সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করতো। যা লেখক জোট হিসেবে পরিচিত। এই প্রানবন্ত আড্ডায় বিবেকদা, ভোলাদা, চিশতি ভাই, শামীম খান, বীরেন মুখার্জী, তপন কুমার তপু, সুশীল শিকদার, দেওয়ান জমির উদ্দীন, অনিল দে মানি, ডা. নাসিরুল ইসলাম, কিশোর গোলদার, শাহান আরা মিশি, সাগর জামান এবং তরুণদের মধ্যে লেখক নিজে রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদ, সালাহ উদ্দীন আহমেদ মিল্টন, কমল হাসান, সুজিত ঘোষসহ দূর দূরান্ত থেকে আসতো আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক। লেখক জোট’র এর ব্যানারে প্রকাশিত হয় ‘লেখক’ ও ‘শেকড়ের সন্ধানে’। ১৯৯৮ সালে অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ এবং ২০০৬ সালে মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদ। সংগঠন দু’টি নতুন সাহিত্যিক সৃষ্টিতে বেশ খানিকটা ভূমিকা রেখেছে। শিকদার ওয়ালিউজ্জামানের সম্পাদনায় ‘নদীপ্রবাহ’ ও ‘সাহিত্য আড্ডা’।  এম এ হাকিম এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ঘাসফুল’। অনিল দে মানি প্রকাশ করেন ‘সেতু’। অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ ও মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদ ২০১০ সাল অবধি মাঝে মাঝে শুক্রবার সাহিত্য-আড্ডার আয়োজন করলেও বর্তমানে সংগঠনের দুটি সাহিত্য আড্ডায় বসছে না। তবে গাঙচিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ও সপ্তক সাহিত্য চক্র এখনও সাহিত্য আড্ডা ও প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। সপ্তক সাহিত্য চক্র প্রকাশিত ছোট কাগজ ‘সপ্তক’ ও ‘জলসিঁড়ি’ বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে আমরা এই আশা রাখছি। 

সাহিত্য-সংস্কৃতির সুসময় আশির দশক (মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু)

মাগুরার সাহিত্য সংস্কৃতিতে আশির দশক একটি সুসময়। তখন প্রেসক্লাব চত্ত্বর, নোমানী ময়দান, মহাকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাহিত্য আসর বসতো। এক ঝাঁক তরুণ লেখক, সংগীত শিল্পী ও কিছু চিত্র শিল্পীরও আবির্ভাব ঘটেছিল। এ সময়ে সাহিত্য কাগজ প্রকাশ হতো আশির দশকে সাহিত্যাঙ্গনের জন্য প্রেসক্লাবের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। ভোলাদা ও চন্ডীদা ওনারা উভয়েই প্রয়াত। সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তাদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। এছাড়া মিহির লাল কুরি, চিশতি ভাই, বিকাশ মজুমদার, কিশোর গোলদারসহ অনেকেই লিটলম্যাগ প্রকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। করিম চিশতি মাগুরার সবচেয়ে আধুনিক কবি। তার লেখা আমার খুব ভাল লাগে। ভোলাদা অত্যন্ত মিষ্টি স্বভাবের মানুষ ছিলেন। আমাদেরকে সব সময় ছায়ার মতো রাখতেন। তার লেখাও ছিল চমৎকার। বিকাশ দা একজন নির্মোহ মানুষ। তরুণ সাহিত্যিকদেরকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা তার অসাধারণ। রোমিও জালালী অসাধারণ সব কাজ করতো। আমরা মোহগ্রস্থ হয়ে ছোট কাগজ করতাম। নাটক করতাম। তরঙ্গ নাট্য গোষ্ঠিতে আমরা নাটক করতাম। জহুরুল ইসলাম ভাল গল্প লিখতো, পরিতোষ দত্ত ভালো গল্প লিখতো। ফাতেমা বেগম বিথী ১৯৮৫ সালে ‘কাগজ’ নামে একটি সাহিত্যের কাগজ প্রকাশ করেন।  পত্রিকার নামটা আমি দিই। প্রচ্ছদ করেছিল শামছুজ্জামান পান্না, কাজল ও রোমিও জালালী। আমাদের এই কয়জনের প্রচেষ্টায় নিউজপ্রিন্টে প্রকাশিত কাগজটিতে চমৎকার লেখনি ও বক্তব্য ছিল।  

কেন্দ্রিক ও বিকেন্দ্রিক সাহিত্য-আড্ডা ( বীরেন মুখার্জী)

শালিখা উপজেলার কিছু সাহিত্যামোদী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় আশির দশকের শেষভাগে (১৯৮৮-১৯৮৯) উপজেলা সদর আড়পাড়া বাজারে ‘শালিখা উপজেলা সাহিত্য পরিষদ’ গঠিত হয়। শালিখা উপজেলা সমবায় অফিসের ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর এ এইচ এম এনায়েতুল করিম এবং রমেশ চন্দ্র সরকার (সাংবাদিক) এ সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন, সীতান বিশ্বাস (শিক্ষক-সাংবাদিক), জালাল উদ্দিন আহমেদ (শিক্ষক-সাংবাদিক), আফসার উদ্দিন আহমেদ (শিক্ষক), সমীরণ সরকার, নাসিম উদ্দিন (লাইব্রেরিয়ান), অরুণ চক্রবর্তী (শিক্ষক), বীরেন মুখার্জী (সাংবাদিক), নির্মল বিশ্বাস প্রমুখ। সমবায় অফিস, উপজেলা মিলনায়তন এবং শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন সাধারণ পাঠাগারে নিয়মিত শুরু হয় মাসিক কবিতা পাঠের আসর। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে ‘রঙধনু’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা হয় ওই বছরেই। প্রথম সংখ্যা সম্পাদনা করেন রমেশ চন্দ্র সরকার আর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলাম আমি। এরপর ‘রঙধনু’র দুটি সংখ্যা এবং ‘শিশির’ নামে দুটি সংখ্যা সম্পাদনা করি আমি। এসব সাহিত্য সংকলনের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা আমার ছিল। মাগুরার সুফিয়া প্রেস, লাকী প্রেস, সত্য প্রেসে ‘রংধনু’ ছাপা হতো। এরপর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন নাসিম উদ্দিন। তার সম্পাদনায় ‘সন্তরণ’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে আমি সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে কাজ করি। ১৯৯২ সালে কিছু তরুণকে কবিতা চর্চায় উৎসাহী হতে দেখা যায়। এদের মধ্যে স্বপন বিশ্বাস, হিটলার এ হালিম, আব্দুর রকিব তরফদার, দীপক চক্রবর্তীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা স্বপন বিশ্বাসের সম্পাদনায় ‘চিত্রিতা’ নামে সাহিত্য কাগজ প্রকাশ করেন। এ সময় অনুজপ্রতিম সমর চক্রবর্তী বোয়ালমারী থেকে সাহিত্য আড্ডা দিতে আসতো শালিখায়। 

মাগুরায় নবগঙ্গা সাহিত্য গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ডা চললেও ১৯৯২ সালের পর থেকে এ আড্ডা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়। এ সময় বিবেকানন্দ মজুমদার, শামীম আহমেদ খান, বীরেন মুখার্জী, ইব্রাহিম আলী মোনাল, সাগর জামান, এম মনির-উজ-জ্জামান , বিকাশ মজুমদারসহ অনেকেই জজকোর্টের সামনে প্রত্যয় সাংস্কৃতিক সংসদে কবিতা পাঠসহ আড্ডায় মিলিত হতেন। এর বাইরে ভোলানাথ শিকদারের লন্ড্রির দোকান, কলেজ রোডে রতনের চায়ের দোকানে আড্ডা চলত। বিকেলে আড্ডা হতো জামরুল তলা বিএমএ হালিমের হোমিও ওষুধের দোকানে। তিনি মহম্মদপুর রোডে দোকান স্থানান্তরিত করলেও সেখানে প্রায় নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন সাগর জামান, বীরেন মুখার্জী, এম মনির-উজ-জামান ও শামীম আহমেদ খান। মাগুরা কোর্ট চত্তরে আড্ডায় মিলিত হতেন রোস্তম মল্লিক, রমেশ সরকার, দাউদ  হোসেন প্রমুখ। 

মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলুর নোমানী ময়দানে শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে আড্ডায় হাজির হতেন, শামীম আহমেদ খান, সাগর জামান, বীরেন মুখার্জী, এম মনির-উজ-জামান । মাঝে মধ্যে এ আসরে যোগ দিতেন ইব্রাহিম আলী মোনাল। পরবর্তীতে যোগ দিতেন আবু বাসার আখন্দ। শরীফ আমিরুল হাসান বুলু সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘মাগুরা বার্তা’ ও আমিনুল ইসলাম শেলী সম্পাদিত ‘গণসংবাদ’ সাহিত্য পাতা প্রকাশ করত। ১৯৯২ সালে শরাফত হোসেন খানের সম্পাদনায় ‘ সাপ্তাহিক খেদমত’ আত্মপ্রকাশ করলে কবিদের আড্ডা চলত থানার সামনে সজল প্রিন্টিং প্রেসের টিনের চালের দোতলায় (খেদমত কার্যালয়)। ১৯৯৪ সালের ২১ ফ্রেরুয়ারি সজল প্রিন্টিং প্রেস থেকে ব্রড শিটে প্রকাশিত হয় ‘দৃষ্টি’র প্রথম সংখ্যা। খেদমত কার্যালয়ে এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে মাগুরার কবি এবং শ্রীপুর, শালিখা ও মহম্মদপুর থেকে কবি-সাংবাদিকরা যোগ দেন। পরবর্তীতে কয়েকটি ব্রড শিট প্রকাশ হওয়ার পর ১৯৯৬ সাল থেকে ‘দৃষ্টি’র আঙ্গিকগত পরিবর্তন আসে। এটি ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত হয়। 

মহম্মদপুরের সাহিত্য আড্ডা(সালাহ উদ্দিন আহমেদ মিল্টন)

মহম্মদপুর উপজেলার সাহিত্য-আড্ডা চলছে ১৯৯৯ সাল থেকে। এ বছর কলমের সৈনিক নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাহ উদ্দিন আহমেদ মিল্টনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কলমের সৈনিক’ কাগজ। প্রতিমাসেই বের করা হতো কাগজটি। পরপর তিন বছর প্রকাশের পর কাগজটি অনিয়মিত হয়ে যায়। ‘কলমের সৈনিক’কে কেন্দ্র করে মহম্মদপুর শহরের আমিনুরের চায়ের দোকান এবং শহীদ আবীর পাঠাগারে নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা শুরু হয় যা এখন পর্যন্ত প্রানবন্তভাবেই চলছে। অধ্যাপক ওসমান আলী এ সব আড্ডার মুখ্য আলোচক এবং নির্দেশক হিসাবে মহম্মদপুর আমিনুর রহমান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আমিনুর রহমান বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। আড্ডাগুলো পরিচালনা করেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ মিল্টন। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য  আড্ডাসঙ্গী হলেন অধ্যাপক জাহাঙ্গীর কবির, জিয়াউল হক বাচ্চু, রফিকুল ইসলাম, শেখ রেজাউল হক রিজু, মুরাদ হোসেন, ইবাদত হোসেন, আবু তাহের, ইমরুল, পলাশ মাহমুদ, দীলিপ কুমার অধিকারী, হাসানুজ্জামান হাসান, সুদেব চক্রবর্তী, শোভন চক্রবর্তী, শাহীন আলমসহ আরো অনেকে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই আড্ডায় মেতে ওঠেন বিভিন্ন বয়সী কবি-সাহিত্যিক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। এছাড়াও সাপ্তাহিক মহম্মদপুর বার্তা ও ত্রৈমাসিক ‘তাকধিং’ মহম্মদপুর কবি-সাহিত্যিকদের লেখনী প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। 

স্মৃতিচারণ থেকে (সাগর জামান)

লিটল ম্যাগ হলো সাহিত্য ভাবনার ছোট কাগজ। শুধুই কি ছোট কাগজ? এটি একটি আন্দোলনের নাম। এর অন্যতম উদ্যেশ্য নতুন লেখক তৈরি করা। আজ যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক তারা সবাই এক সময় লিটল ম্যাগে লিখেছে। আমি লিটল ম্যাগ নিয়ে অনেক কাজ করেছি। লিটল ম্যাগ সংগ্রহ করার জন্য আমি বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে গেছি। নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে কাগজ করেছি। এ সময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সহযোগিতার অভাব ছিল অবর্ণনীয়। লেখকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে লিটল ম্যাগ কর্মীরা তেমন মূল্যায়িত হয় নি। পরিচিতিও আসে নি।  ৭৫ পরবর্তী সময়ে নবগঙ্গা প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯৭৯ সালে বর্তমান সাইফুজ্জামান আগে রোমিও জালালী ছান্দসিক কবি কাদের নওয়াজ এর নামে কাদের নওয়াজ সাহিত্য সংসদ (কানসাস)প্রতিষ্ঠা করেন। কানসাস এর প্রথম সংখ্যায় কাদের নওয়াজ এর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়। আমাদের বাড়ির সামনে একটি মাঠ ছিল। আমি তখন ছোট। ওখানে কানসাস এর প্রথম আসর বসেছিল। এই আসরে মাগুরা ও ফরিদপুরের অনেক খ্যাতিমান লেখক এর আগমন ঘটেছিল। আমার বড় ভাই রোমিও জালালী ‘শব্দ’ নামে একটি কাগজ করেন। তখন নবগঙ্গার পাশাপাশি একটি ধারা তৈরি হয়েছিল। মূলত কানসাস ধারা। ঢাকার নামী লেখকরাও ‘শব্দ’ পত্রিকায় লিখত। ছোট কলেবরের হলেও এর মান ছিল অনেক ভাল। লিমা নাসরিন(তসলিমা নাসরিন), আবু হাসান শাহরিয়ার, শহীদুল্লাহ সিরাজী, প্রবীর শিকদার সুজন, সুবল বিশ্বাস, এম এম তারিক, মিনার মাহমুদসহ মাগুরার বাইরের অনেক নামিদামী লেখক এ পত্রিকায় লিখত। ১৯৮৯ সালে আমি ‘অভিজ্ঞান’ নামে একটি পত্রিকা করি। ১৯৯১ সাল থেকে ‘নীল আকাশ সোনালী রোদ’্র, ‘অমল ধবল দিন’, ‘শব্দের আর্তনাদ’, ‘আলোকের এই ঝর্ণাতলে’ প্রকাশ করেছি। আমি হাসান হাফিজুর রহমান এর অপ্রকাশিত লেখা তার কন্যা এশা হাসানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছি। এটা খুবই দূরুহ কাজ ছিল। আমার সময়ে কাজল খন্দকার সম্পাদিত ‘হিজিবিজি’, শামীম আহমেদ খান এর ‘জনক’, ‘মৌনমুখর’ ‘সশস্ত্র হবো অজস্র মৃত্যুতে’, ‘প্রতিক্রিয়া’, অলোক বোস এর ‘হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু’, সাহেব আলী সম্পাদিত ‘মুক্তি’  এবং বিবেকানন্দ মজুমদার, ইব্রাহীম আলী মোনাল, এম মনির-উজ-জামান ও ভোলানাথ সিকদারের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘উদয়’।  এখন যারা লিটল ম্যাগ প্রকাশ করে তাদের অনেক যোগাযোগ সহজ হয়ে গেছে। বিবেকানন্দ মজুমদারের জাগরনী। আমার ভাইয়ের কারণে অনেক ছোট বয়স থেকেই মাগুরার সাহিত্যিকদের নামের সাথে পরিচিত ছিলাম। পরে ক্লাস এইট থেকে আমি সাহিত্যাঙ্গনে আমি প্রবেশ করেছি। আমি, শামীম ভাই, বীরেনদা, জামান ভাই এর পর অনেকটা গ্যাপ তৈরি হয়েছিল। সেই গ্যাপের পর আসে শিকদার ওয়ালিউজ্জামান। উন্নত প্রযুক্তির কারণে ভাল কাগজ, ভাল ছাপা, দেশের বাইরে থেকেও লেখা সংগ্রহ করে অনেক ভাল কাজ করছে।

সাহিত্য অঙ্গণ এবং উত্থান পতন (ইব্রাহিম আলী মোনাল)

১৯৭৫ সালে কবি-সাহিত্যিকগন মাগুরার প্রথম সাহিত্য সংগঠন ‘নবগঙ্গা সাহিত্য গোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন। মতবিরোধের কারণে নবগঙ্গার একাংশ ১৯৮১ সালে ‘মাগুরা সাহিত্য পরিষদ’ গঠন করে যার প্রথম সভাপতি ছিলেন খান জিয়াউল হক। তারপর সভাপতি হন করিম চিশতি এবং সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার গোলদার। অন্য আরেকটি অংশ মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলুর সভাপতিত্বে তরঙ্গ সাহিত্য গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন যার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জহুরুল ইসলাম। আশির দশকের মাঝামাঝিতে মাগুরা আবৃত্তি সংসদ নামে আরেকটি সংগঠনের আতœপ্রকাশ ঘটে। আশির দশকের শেষের দিকে দাউদ হোসেন, ইব্রাহিম আলী মোনাল, কিশোর কুমার গোলদার প্রতিষ্ঠা করেন ‘অনুপ্রাস’। দীর্ঘদিন নিস্ক্রিয় থাকার পর শামীম খান সভাপতি ও ইব্রাহিম আলী মোনাল সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৯০ সালে প্রভাতি সাহিত সংসদ ভেঙ্গে অনিল দে মনিকে সভাপতি ও ইব্রাহিম আলী মোনালকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘নির্মান সাহিত্য সংসদ’। ১৯৯১ সালে জেলার সকল সাহিত্য সংগঠন ভেঙ্গে ‘জেলা সাহিত্য নিকেতন’ আতœপ্রকাশ করলেও বেশিদিন টেকেনি। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আমির হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইব্রাহিম আলী মোনাল। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লেখক জোট’। সভাপতি ছিলেন মিয়া ওয়াহিদ কামাল বাবলু ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইব্রাহিম আলী মোনাল। মাগুরা ডিসি কোর্ট উকিল বারে এর জমজমাট সাহিত্য আড্ডা হতো। ১৯৯৮ সালে খন্দকার রাশিদ আশরাফ সভাপতি ও শিকদার ওয়ালিউজ্জামান সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তরুণ সাহিত্যিকদেরকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ’। ২০০৭ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে হাফেজা আনোয়ার সভাপতি ও শিকদার ওয়ালিউজ্জামান হিসাবে পুনরায় সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন। ২০০৬ সালে মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালে এর একাংশ মোঃ আব্দুল কুদ্দুসকে সভাপতি ও পরেশ কান্তিকে সাধারণ সম্পাদক করে গাংচিল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ ভেঙ্গে একটি অংশ ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করে ‘সপ্তক সাহিত্য চক্র’। সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পান বিকাশ মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে শিকদার ওয়ালিউজ্জামান। অনেক উজ্জীবিত হয়ে সংগঠনগুলোর জন্ম হলেও স্বেচ্ছাচারিতা ও সংকীর্ণতার কারণে কষ্টে গড়া সংগঠন এর ইতি টানতে হয়। 

শূন্য দশক মাগুরা সাহিত্যের বাক বদলের কাল

১৯৯৮ সালে খন্দকার রাশিদ আশরাফ, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, হাফেজা আনোয়ার, রাশেদুল ইসলাম সাজ্জাদ, খন্দকার ইদ্রিস আলী, আশীষ রায়, এস এম তুষার আলমসহ আরো অনেক তরুণ সাহিত্যপ্রেমীর সমন্বয়ে  গঠিত হয় অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ।  শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘নদীপ্রবাহ’। তখন জমজমাট সাহিত্য আসর বসতো নবীন লেখিয়েদেরকে নিয়ে। একই সালে খান মাজহারুল হক লিপুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে আবৃত্তি সংগঠন ‘কণ্ঠবীথি’। ২০০১-২০০৬। মাগুরা সাহিত্যে অন্ধকার সময়। এ সময় তেমন কোন সাহিত্য আড্ডা বা ছোট কাগজ প্রকাশিত হয় নি। ২০০৬ সালে মাগুরা সাহিত্যিক কল্যাণ পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাগুরা শহীদ সৈয়দ আতর আলী পাঠাগারে শুরু হয় সাহিত্যে আসর। বিবেকানন্দ মজুমদার, এম এ হাকিম, পরেশ কান্তি সাহা, মোঃ আব্দুল কুদ্দুস, দাউদ হোসেন, হাসানুজ্জামান হাসান, শাহান আরা মিশি, খান জান্নাতুল ফেরদৌস আলাপী, হাসান সাব্বির, আঃ রশিদ মিয়াসহ আরো অনেক কবি-সাহিত্যিকের সমাগম হতো শুক্রবারের এই আসরে । এ সংগঠনের প্রকাশনায় ‘ঘাসফুল’ নামে ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়।  দু’বছর সাহিত্য আসর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়।  ২০০৭ সালে অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে নিজস্ব কার্যালয়ে প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় শুক্রবার সাহিত্য আসরের আয়োজন করে। এ সব আসরে বিকাশ মজুমদার, হাফেজা আনোয়ার, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, ফসিয়ার রহমান, পরেশ কান্তি সাহা, ডা. নাসিরুল ইসলাম, এম মনির-উজ-জামান, বীরেন মুখার্জী, সাগর জামান, কাব্য মোস্তফা, জিল্লুর রহমান খান, এস এম কামরুজ্জামান, সঞ্জিত বসু, কাজী সিরাজ মিহির ও হাসান সাব্বিরসহ আরো অনেকে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করতেন।  অনির্বাণ সাহিত্য সংসদ এর প্রকাশনায় শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এর সম্পাদনায় ‘নদীপ্রবাহ’ ও ‘সাহিত্য আড্ডা’, সঞ্জিত বসু’র সম্পাদনায় ‘মাটি’ এবং জিল্লুর রহমান খান এর সম্পাদনায় ‘আঁচড়’ প্রকাশিত হয়। ২০১০। অনির্বাণ সাহিত্য সংসদের সাহিত্য আসরের ইতি। ২০১১ মাগুরা সাহিত্য অঙ্গণে বৈপ্লবিক সময়। ‘সপ্তক সাহিত্য চক্র’ নতুন আঙ্গিকে মাগুরার কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকার ও সাহিত্যপ্রেমিদেরকে নিয়ে শুরু করে পথ চলা। কোন নির্দিষ্ট দিনে নয়। এই সংগঠনের সাহিত্য আড্ডাসমূহ সেন্টুর চায়ের দোকান, মাগুরা সৈয়দ আতর পাবলিক লাইব্রেরী, নোমানী ময়দান ও এ জি একাডেমী স্কুল প্রাঙ্গণ, সাতদোহা আশ্রম, মাগুরা কফি হাউজ, সরকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তক এর সাহিত্য আড্ডায় অসীম সাহা, তপন বাগচী, ওয়ালী কিরণ, সমর চক্রবর্তী, তুহিন দাসসহ আরো অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক অংশগ্রহন করেছেন। বিকাশ মজুমদার, অনিল দে মনি, আফরোজ জাহান, এম মনির উজ জামান, বীরেন মুখার্জী, কাব্য মোস্তফা, শিকদার ওয়ালিউজ্জামান, তুষার প্রসূন, নাসিরুল ইসলাম, হাসান সাব্বির, নিষাদ নয়ন, রোকেয়া খাতুন, হাসিয়ারা খাতুন হাসি, শিপ্রা দাশ, খান মাজহারুল হক লিপু, আশীষ রায়, মিরাজ হোসেন ও এস এম কামরুজ্জামানকে  গঠিত সপ্তক সাহিত্য চক্র এবং এ সংগঠন থেকে ছোট কাগজ ‘সপ্তক’ ও ‘জলসিঁড়ি’ প্রকাশিত হচ্ছে। এ সময়ে আরো কয়েকটি ছোট কাগজের মধ্যে শামীম খান সম্পাদিত ‘চৌরঙ্গী’, কাজী সিরাজ মিহির সম্পাদিত ‘সময় মাত্রা’, অনিল দে মনি সম্পাদিত ‘সেতু’, সোহেল সবুজ সম্পাদিত ‘কবিতা এক্সপ্রেস’ এবং সুদেব চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘গেরিলা’ উল্লেখযোগ্য।     

অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও লিটল ম্যাগ চর্চা এগিয়ে যচ্ছে (তুষার প্রসূন)

ছোটকাগজ চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সবসময় আমাদেরকে ভালোবেসে জড়িয়ে রাখে। প্রধানত ছোটকাগজ চর্চায় এগিয়ে আসে তরুণরা। তাদের থাকে উদ্যম কিন্তু পকেট যথেষ্ট ভারী না থাকায় দ্বারস্থ হতে হয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। সেখানে গিয়ে তারা বেশীরভাগ জায়গা থেকে শূন্য হাতে ফিরে আসে। তবে যারা বিজ্ঞাপনের টাকা দিতে রাজি হন তাদের শর্ত থাকে। আগে কাজ দেখা তারপর বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করা। কিন্তু এতো কষ্ট করেও ফল হয় উল্টো। অর্থাৎ কাগজ করার পর বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধ করতে বিজ্ঞাপনদাতারা আগ্রহ হারিয়ে ফ্যালেন ফলে তরুণরা পড়ে বিপাকে। এরপর আছে ম্যাগাজিন বিক্রি প্রসঙ্গ। আবালবৃদ্ধ যার কাছে যাওয়া যায় তাদের কাছে বছরে ৫০ থেকে ১০০ টাকা ম্যাগাজিন বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া যায় না। অথচ প্রতিদিন তারা সিগারেট,  মোবাইল, ইণ্টারনেট এর পেছনে খরচ করছে শত শত টাকা। তারপরও তরুণরা কখনও নিজেদের পকেট থেকে অথবা কোন সাহিত্যরসিকদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে  ছোট কাগজ চর্চা এগিয়ে নিয়েছে। আশাকরি এ অভ্যাস চলবে।

ছোট কাগজ করতে গিয়ে বড় কাগজ করে অনেকে বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছেন তবু বাংলাদেশে প্রতিবছর অগণিত ছোট কাগজ বের হয়। আমাদের শহর মাগুরা সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। শিকদার ওয়ালিউজ্জামান সম্পাদিত ‘সপ্তক’, যৌথ সম্পাদনায় ‘জলসিঁড়ি’ সহ আরও অনেক কাগজ নিয়মিত বের হচ্ছে। কাগজগুলোতে লিখছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অগণিত তরুণ ও প্রবীণ লেখক। সেখানে গল্প, কবিতা, অনুবাদ, প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পেরে দিন দিন ঋদ্ধ মাগুরার সাহিত্য অঙ্গন। আশা করছি অতীতেও যেমন মাগুরার প্রথিতযশা সাহিত্যিক সৈয়দ আলি আহসান, ফররুখ আহমদ, কাজী কাদের নওয়াজ, ডা. লুৎফর রহমান জাতীয় অঙ্গনে তাদের প্রভাব রেখেছেন  আগামীতেও মাগুরার সাহিত্যিক মহল অবদান রাখবেন।

সপ্তক এর লিটল ম্যাগ হয়ে ওঠার চেষ্টা ( নাসিরুল ইসলাম)

লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার মধ্যে পার্থক্য আছে। সাহিত্য পত্রিকায় কবি-সাহিত্যিকরা লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। লিটল ম্যাগ এর একটি ইতিহাস আছে। নতুন স্বর ও নতুন ভাবনা তৈরি হলেই সেটাকে আমরা তাকে লিটল ম্যাগ বলতে পারি। লিটল ম্যাগ বলতে আমরা যা বুঝি তার  খুব কমই আমাদের চোখে পড়ে। নতুন একটা ভাবনা এনে দিল, নতুন একটি স্বর এনে দিল বাংলাদেশে এ রকম লিটল ম্যাগ খুব কমই আছে। সপ্তক লিটল ম্যাগ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। লিটল ম্যাগ হয়ে ওঠার চেষ্টা অব্যাহত থাক…  

লিটলম্যাগের অভিপ্রায় ও স্পষ্ট চেতনাগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকে… (নিষাদ নয়ন)

লিটল ম্যাগের একটি নির্দিষ্ট কনসেপ্ট আছে। এখানে থাকবে দ্রোহ, রাজনৈতিক একটি চেতনা থাকবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থাকবে, নিরীক্ষা থাকবে, নতুন লেখা এবং নতুনদের জন্য সুযোগ থাকবে। একটি গোষ্ঠিবদ্ধতার চর্চাও থাকতে পারে। প্রত্যেকটা লিটল ম্যাগই একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর, নির্দিষ্ট চিন্তার কিছু মানুষের চেতনা নিয়ে গড়ে ওঠে। সেভাবেই তারা আবর্তিত হয়। লিটল ম্যাগের কনসেপ্ট আমাদের দেশে এসেছে আশির দশকে। লিরিক, গা-ীব, প্রতিশিল্প, দ্রষ্টব্য, নিসর্গ, একবিংশ, জংশন, শিরদাঁড়া এগুলোকে লিটল ম্যাগ বলা যায় প্রকৃত অর্থে। লিটিল ম্যাগের কনসেপ্ট দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। লিটল ম্যাগের ক্ষেত্রে কোন কাঠামোবদ্ধতা থাকে না। তাদের প্যাটার্ন, উপস্থাপনা, উপজীব্য আলাদা হয়। লিটল ম্যাগের কাছাকাছি আরেকটি কনসেপ্ট হলো মিডিম্যাগ। এগুলো না লিটল ম্যাগ না সাময়িকী। মিডিম্যাগে কোন রাজনৈতিক চেতনা থাকে না। বর্তমানে যেগুলোকে লিটল ম্যাগ বলা হচ্ছে মূলত এগুলো মিডি ম্যাগ। লোক, সপ্তক, শালুক এগুলো লিটল ম্যাগ নয়, এগুলো মিডি ম্যাগ। লিটল ম্যাগ কখনো সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি বিচার করে না। নতুন লেখককে সুযোগদানে কোন কিছু লিখিয়ে নেওয়াই লিটল ম্যাগের প্রধান বৈশিষ্ট। লিটল ম্যাগ কোন নির্দিষ্ট সময়ে করতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মাগুরার যে সমস্ত কাগজ হয়েছে এগুলো কোন সময়ই লিটল ম্যাগ এর আওতায় পড়ে নি। এগুলো মূলত সাহিত্য পত্রিকা। এগুলো কিছু গদ বাঁধা নিয়মেই আবর্তিত হয়েছে। আবার মাগুরার শেকড়, মাগুরার লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য কমই উঠে এসেছে এসব কাগজে। মাগুরার সাহিত্যপত্রিকাগুলো নিজস্ব ঘরানারও হয়ে ওঠে নি। 

মাগুরার যারা অগ্রজ কবি-সাহিত্যিক, তাদের সাথে অনুজদের তেমন সম্পর্ক কোনকালেই গড়ে ওঠে নি। মাগুরার যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক খ্যাতি পেয়েছেন তাদের সাথে মাগুরার মানুষের তেমন যোগাযোগ ছিল না। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, আজিজুল হকের নাম অতি উজ্জ্বল। শেকড়ের সাথে হয়তো তাদের সংযোগ ছিল কিন্তু মাগুরার লিখিয়েদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই কম। যোগাযোগ না থাকার কারণে সাহিত্যে সমসাময়িক হালচাল জানার সুযোগ এখানকার লিখিয়েদের খুবই কম হয়েছে। উন্নতমানের লিটল ম্যাগের সাথে পরিচয় তাদের তেমন হয় নি। যশোরের প্রতিথযশা কবি-সাহিত্যিক যেমন মাইকেল মধুসূদন, প্রমথ চৌধুরী, গৌর কিশোর ঘোষ পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের সাথে ওখানকার অনুজদের পরিচয় করিয়েছেন মাগুরা সাহিত্যে তেমন কেউ এগিয়ে আসেন নি। এখানকার লেখকরা আঞ্চলিক চর্চার মধ্যেই সর্বদা সীমাবদ্ধ থেকেছেন। মাগুরার গ-ি থেকে তারা কখনোই বের হতে পারেন নি। মানুষ নিজের ভেতরে আবদ্ধ থাকলে বাহ্যিক অনেক কিছুই দেখার সুযোগ থাকে না। তেমনটিই হয়েছে মাগুরা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও। এখান ছোট কাগজ কর্মীদের হয়তো উদ্দেশ্য ছিল মহৎ কিন্তু লক্ষ্য ছিল সংকীর্ণ। অনেক বছর পরে হলেও মাগুরায় লিটল ম্যাগ কনসেপ্ট এসেছে। এটা ভাল দিক এবং ‘সপ্তক’ এর মাধ্যমেই সেটা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে অনুজপ্রতিমেরা এ ধারা অব্যাহত রাখবে হয়তো। 

মন্তব্য: