দুঃখের গহনায় অনেক সাজিয়েছি তােমায়
নীল পাত্রে রেখে, দেখেছি পদ্যের অলংকারে
জলের সহজতায় দেইনি
পিয়াসের সুখ…
আজ চৈত্রের খরতাপ, সবুজ চারাগুলাে
ম্লান, জমিন চৌচির, এখানে ওখানে
অনেক ফাটলের সমাহার
প্রত্যাশিত চাতক যেন। উর্ধ্ব সুখ
আকাশে মেঘের দেখা নেই,
শুধু সন্ধানী চোখে নির্বাক
জীবনের পাণ্ডুলিপি এপিঠ ওপিঠ
করে ফেরে, এতটুকু সুখ দেবাে বলে।
কবিতার জটিলতা ছেড়ে
গদ্যের সহজ সমাধানে
কাঁচির বুক যন্ত্রণা বুকে
খুঁজে খুঁজে আগাছায় শেকড়
কেটে কেটে এক সময়
বর্ষার সহজ ধারার মতাে ঘন ঘাের বর্ষায়
ভরিয়ে দিতে দুঃখের খাল বিল, নদী-নালা
সেখানে স্বচ্ছ সরােবরে
লাল-সাদা শাপলার মাঝে
হংস মিথুন মন সুখ
রাত ভাের জোছনায় রূপকথার কাহিনীর মতাে
সােনালী ধানের রােমাঞ্চ কথক বলে,
স্পুন, ফরাসী, গুজরাটি, মারাঠি, মুঘল, পাঠান,
বেনিয়া ইংরেজ খান হতে আজতক
পুতুল বাঙ্গালীর নীল নকশার খবর।
তােমায় এতটুকু সুখ দেবাে বলে-
নূর হােসেন বুকে মুক্তির পােস্টার লাগায়
শহীদের লাল শার্ট বাতাসে ওড়ে
বিপ্লবীর রক্তে তােমার শাড়ির
আঁচল ভিজে যায়, তােমায় এতটুকু সুখ দেব বলে।
প্রকাশ্য দিবালােকে জমির চাচার খুলি
তােমার গলায়-মণিহার হয়ে দোলে
হাজরা বিবি কাফনের মােড়কেই বন্দী
জমিলা সামিল হয় রাতের বিনােদনে
পরান মন্ডলের জমি জিরেত হয়ে যায়,
তােমায় এতটুকু সুখ দেবাে বলে।
সলেমান কম্পােজিটর-সারাদিন টাইপ খুঁটে বলে-
কখন পেটের আগুন আর সূর্যের আগুন একসাথে আরও লাল হয়ে উঠবে
জ্বলবে আমার চিতা,
তােমায় এতটুকু সুখ দেবাে বলে।
কবি কাঙাল পথে পথে
সায়ের গেয়ে সারাদিন
পরায় ত্রিপদীর তালে সাধে
জীবনের সারগাম-
সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি, সা
তােমায় এতটুকু সুখ দেবাে বলে।
আজও
জীবনগদ্যে ও পদ্যে কথা কয় ।
“তােমায় এতটুকু সুখ দেব বলে” শিরােনামের এই অনুপম কবিতার কবি ভােলানাথ সিকদার। ১৬ মে, ১৯৪৯ সালে মাগুরা জেলার গােয়ালখালী গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন নিজনান্দুয়ালী গ্রামে। তার পিতার নাম কৃষ্ণপদ সিকদার ও মাতার নাম শ্রীমতি শান্তি রাণী সিকদার। আট (৮) ভাই ও বােনের মধ্যে কবিই প্রথম। কবি ভােলানাথ সিকদার যখন অষ্টমশ্রেণীর ছাত্র ঠিক তখন থেকেই কবি ছবি আঁকিঝুকি ও কলম চালনা করতেন। তারই সূত্র ধরে কবিতা লেখার হাতেখড়ি। তার প্রথম জীবনের একটি কবিতার শিরােনাম “কি করে তােমার কাছে যাই এই কবিতায় কবি লিখেছেন-
আবারাে আসছে তেড়ে
ষাড়ের মতাে ধেয়ে নূহের প্লাবন।
বাঙ্গালীর হাড়ের তলদেশ থেকে ক্রমেই ফুসে উঠছে
নােনা পানি।
জলবদ্ধ হচ্ছে সড়ক জনপদ, মহানগরী গারস্তের আঙ্গিনা।
সাদা পােশাকী গৃহবন্দি সব।
কাদা ভেঙ্গে নেংটোরা
উপরে আসছে উঠে
কাঁধে ভর করে মৌলিক তাগিদে।
তাদের এ প্রয়ােজন তে তলার ছাদ,
এখন বেগতিক সব এলােমেলাে
কি করে তােমার কাছে যাই;
কুশলি বলি তুমি কেমন আছে।
১৯৬৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর কবি তােলানাথ সিকদার কলেজে ভর্তি হন এবং বৎসরখানেক তিনি কলেজজীবন অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে আর্থিক অভাব অনটনের কারণে কবি’র লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। সংসারের সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনবার মানসে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কবি মূলত : একজন ব্যবসায়িক ছিলেন। সারাদিন কর্মব্যস্ত থেকেও তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন। কবি ভােলানাথ সিকদার ১৯৬৯ সালে বােয়ালমারী উপজেলাধীন ধুল পুখরিয়া গ্রামের বাবু প্রমনাথ রায়ের সুন্দরী কন্যা হিরারাণীকে বিবাহ করে সংসারজীবনে প্রবেশ করেন। কবি ভােলানাথ সিকদার ২৫মে ২০০২ ইং সালে পরলােক গমন করেন।
তিনি দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। কবি ভােলানাথ সিকদার একাধারে একজন সৃজনশীল কবি, ছােটগল্পকার, সংগঠক ও হােমিওপ্যাথি চিকিৎসক ও সুখ্যাত আবৃত্তিকার ছিলেন মাগুরা জেলার সাহিত্যাঙ্গনে কবি ভােলানাথ সিকদার একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কবির মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে ‘ঘর শিরােনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সম্ভবত এটিই কবির শেষ কবিতা। ঘর কবিতায় কবি লিখেছেন-
তােমার দীঘল বুকের পর
আছে আমার ছােট্ট ঘর
যা সত্যের মতাে অনড়।
ভয় কি আছে ফিরে যাবার
ফিরতে হলে আসব আবার
তােমার বুকেই বারংবার।
কবির বহু কবিতা, ছােটগল্প, প্রবন্ধ, মাগুরা জেলার স্থানীয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। কবি’র সম্পাদনায় বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উদীচী ও সময় স্রোত উল্লেখযােগ্য। কবির রচিত কোনাে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মাগুরা জেলার ১২ জন শক্তিমান লেখকের সম্পাদনায় “আমরা বারজন” পত্রিকার আমরা বার (১২) জনের অন্যতম কবি ভােলানাথ সিকদার। তার অপ্রকাশিত বেশ কয়েকটি পাণুলিপি রয়েছে। যেমন : ‘সময়স্রোত’, শিল্প ও নারী’, জ্যোতিষীর দুয়ারে হাত’, ‘ভালবাসার ফুল’, “সিকদার বাড়ির হিরারাণী’, অষ্টপ্রহর ইত্যাদি।