1. স্মরণীয় বরণীয়

মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী (১৯১২ – ১৯৮৯)

কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী ১৯১২ সালে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলাধীন গােয়ালখালি গ্রামে গােস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর স্বর্গীয় পিতার নাম নিবারণ গােস্বামী। যখন মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর বয়স মাত্র চার (৪) বছর, সে সময় তিনি পিতৃহারা হন। ফলে তাঁদের পরিবারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য, পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দেয়। পিতৃহারা অভিভাবকহীন সংসারে একটু সুখ-শান্তির প্রত্যাশায় মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী; সপ্তমশ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে।

কিশােরবয়সে সংসারের সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনার মানসের জন্য কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। শৈশবকাল থেকে মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর কণ্ঠ খুব ভালাে থাকার কারণে, কর্মজীবনের সূচনা থেকে সিংহেশ্বর গ্রামের রামবসু মহাশয়ের যাত্রাদলে যােগ দেন। সেখানে প্রায় এক বছরের বেশি সময় কাজ করার পর বাড়িতে ফিরে

আসেন। পরবর্তীকালে মেসের ঠাকুর হুলির হট্ট গ্রাম নিবাসী “মহেন্দ্র নাথ গােস্বামীকে ভাসান গানের দলে নিয়ে যান। সেই ভাসান গানের দলটি বছরখানিক চলার পর আর্থিক সংকটের কারণে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু গানপাগল মহেন্দ্র নাথ গােস্বামী এবপর সাবলাট গ্রামের ভূষণ চন্দ্র বিশ্বাসের সাথে গাজীর গানের দলে যােগদান করেন। গাজীর গানের দলে সুদীর্ঘ ১২ বছর তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। গানের প্রতি অনুরাগ দেখে, ক্ষ্যাপাচাঁদ গােস্বামী যিনি সম্পর্কে মহন্দ্রনাথ গােস্বামীর কাকাবাবু হতেন। একদিন তিনি বললেন, মহেন্দ্রনাথ যে, গান তুমি গেয়ে বেড়াও ও সকল গানে কোন মাধুর্য, রস নেই। এখন থেকে তুমি ভাবগান শেখাে। আমি নিজেই তােমাকে ভাবগান শেখাবাে। তরুণ মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর মনে তাঁর কাকাবাবু ক্ষ্যাপাচাদ গােস্বামীর কথাগুলাে বেশ ভালাে লাগলাে। তিনি রাজি হলেন এবং গুরু থেকে ভাবগানের পাঠ নিতে লাগলেন। সংগীত নামক সমুদ্রে ঢুকে সংগীত তৃষা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলাে শিল্পীর। সংগীতসুধা আহরণের আশায় পরবর্তী পর্যায়ে কুশখালি গ্রামের কবিয়াল জনাব আমান উদ্দিন বিশ্বাসের কাছ থেকে গুরুজ্ঞানে ভাবগান শিক্ষা গ্রহণ করেন। সংগীতভুবনে সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় চূড়ান্ত পর্যায়ে জারিগান ও ভাবগানের গুরু ছিলেন কবিয়াল জনাব আজহার উদ্দিন বিশ্বাস। এই সংগীতসাধক আজীবন সংগীতকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। জীবন-জীবিকার জন্যে একমাত্র পেশা হিসেবে ভাবগানকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। তিনি সংগীতভুবনে সুদীর্ঘ (৫০) বছরের পদচারণায় অনেক যশ ও সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন। লােকসংগীত চর্চার আপনভােলা- এই সাধক জীবনের বিভিন্ন সময়ে নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। আঞ্চলিক বেতার খুলনার প্রতিযােগিতামূলক ভাবগানের অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ বেতার ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস আয়ােজিত জাতীয়ভিত্তিক দ্বিতীয় লােকসংগীত ও উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্মেলনে লােকসংগীত পর্যায়ে অংশ নিয়েছেন এবং কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ভারতসরকারের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনছুর উদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বাউল প্রতিনিধি দলের একজন হয়ে তিনি ভারত সফর করেন। ১৯৮৩ সালের ১৫ জানুয়ারি, কলকাতার ইচ্ছাপুর অনুশীলনী ও পাঠাগারের উদ্যোগে বাংলাদেশ ও ভারতের সাংস্কৃতিক মিলনসন্ধ্যায় গুণীজন সংবর্ধনা দেয়া হয়। স্বাধীনতানত্তোর বাংলাদেশের কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজে বালিন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ম্যান ড্রিলম ইউলিয়ামের সাথে মহেন্দ্র গােস্বামার সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাৎকার পর্ব শেষে ভাব ও বাউলসঙ্গীত পরিবেশিত হয়। গান শুনে ম্যানড্রিলম ইউলিয়াম সাহেব ভূয়সী প্রশংসা করেন। মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী নিজে গান লিখতেন এবং সুর দিয়ে দর্শক শ্রোতাকে মঞ্চে তা গেয়ে শােনাতেন। তিনি বেশ কিছু গান, কবিতা ও অন্যান্য লেখা লিখেছিলেন। এ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিয়াল, ভাব ও জারিগানে লাখ লাখ মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। বিদগ্ধ পাঠকসমাজের কাছে মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর শেষ বয়সের দু’গানের অংশ:

সাধের একতারা

তাের লাগিয়া হইলাম পাগল পারা।

তার যায় জাতিকুল হয় সে বাউলরে,

তাের সাথী হয় যারা।

কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর পরলােক গমনের ২০ দিন আগে ২৫/০৮/৮৯ইং সালে একজন ভক্ত অনুরাগী, তপনকুমার বসুকে নিয়ে বর্ণিত গানটি লিখেছেন

‘হলে মন সত্যবাদী, অপরাধি যাবে কেটে

হয়ে সত্যের পূজারী রয় হুজুরী, কামকী আসে তার নিকটে

পুরুষ প্রকৃতি দোহে ভুল না কামের মােহে

কাম বিকার আপন দেহে যদি ওঠে

উভয় উভয় অনুগা; প্রেমের আগা

অনুরাগে বান্দ এটে।

প্রকৃতির লয়ে স্মরণ মরগে জ্যান্ত মরণ

রেখ সেই ফণির বদন ভেকের বাটে

হয়ে মন আপন ভােলা প্রেমের খেলা

খেল তখন নিঙ্কপাটে।

কতজন জ্ঞানের পাছে জন্ম ভরে ঘুরিতেছে।

ঘুরে সে পড়ল পাছে ভবের হাটে

মহেন্দ্রনাথ কেবল গানের পাগল

হাওয়ায় সম্বল ভােলার ঘাটে।

সম্ভবত মহেন্দ্রনাথ গােস্বামীর এই গানটি জীবনের সর্বশেষ গান। অসুস্থ অবস্থায় মাগুরা শহরে চিকিৎসাকালীন সময় গানটি রচনা করেন। ভাব, বাউল, জারিগানের এই একনিষ্ঠ সাধক, জীবনের শেষদিনগুলাে ভীষণ কষ্টে কাটিয়েছেন। অন্তিম মুহূর্তের কয়েক মাস, মাগুরা জেলা শহরের ভায়না

গ্রামে বিশিষ্ট লেখক ও এডভােকেট জনাব আব্দুল আজিজ সাহেবের বাসায় তিনি অবস্থান করেন। আব্দুল আজিজ সাহেব শিল্পীর চিকিৎসার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও দরিমাগুরার (বটতলার) বাবু মনোেরঞ্জন বসু, এই দু’জন সুহৃদ অনুরাগী সেবা ও চিকিৎসা ও অর্থ দিয়ে শিল্পীর জন্য অনুরাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবুও অন্তিম ডাক এলাে, কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী, এডভােকেট আব্দুল আজিজ সাহেব ও বাবু মনোরঞ্জন বসু’র কাছে নিজ গ্রাম গােয়ালখালিতে ফিরে যেতে চাইলেন। আব্দুল আজিজ সাহেব মাগুরা জেলা শহরের শান্তি ক্লিনিক থেকে এ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে শিল্পীকে নিজ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। গ্রামে ফিরে গিয়ে শিল্পী খবর দিলেন শেষ জীবনের ভাবগানের সহযােগী কবিয়াল করিম শাহকে, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের বললেন, সাধু সেবার আয়ােজন করতে। কাছে ডেকে নিলেন কবিয়াল করিম শাহকে, আস্তে আস্তে কী যেন বললেন তাঁকে। তারপর ঘাষপাড়া নিবাসী কবিয়াল লালন যােশীকে যে গানখানি গাইতে বললেন, তা নিম্নে প্রদত্ত হলো :

অপরাধ মার্জনা কর প্রভু,

জন্ম জন্মান্তরে তব সংসারে

মতিভ্ৰম ঘটে না যেন কভু।

কবিয়াল করিম শাহ্ গানটি গাইতে লাগলেন একতারা বাজিয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রাণমন দিয়ে…। চোখ বুজে গান শুনলেন ভাবুক কবিয়াল মহেন্দ্রনাথ গােস্বামী আপন মনে।সবাইকে আর একবার দেখে নিলেন। ১৯৮৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, রাত দশটায়, জন্ম জন্মান্তরে তব সংসারে মতিভ্রম ঘটে না যেনকভু গান ছিল যার প্রাণ, সেই মধুর সুরের সাধক, সুর সুধা গান করতে করতে চির বিদায় নিলেন।

মন্তব্য: