1. লোক

লোকজ সামাজিক অনুষ্ঠানসমূহঃ

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও আমাদের সমাজে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই রয়েছে কিছু পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান। মাগুরা অঞ্চলে বিভিন্নভাবে পালন করা হয় এসব অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে বিবাহপূর্ব ও বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান, গর্ভবতী রমনীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান, সন্তানদের নামকরণ অনুষ্ঠান, সন্তানদের চুল কাটার অনুষ্ঠান, সন্তানদের আকিকা, পুত্র সন্তানদের ক্ষেত্রে সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠান এবং অতিথি-আপ্যায়নও লোক-বিশ্বাসকে পুঁজি করে অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানগুলোর ধরণ ও রীতি নিম্নরূপÑ

গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানঃ মুসলমান ও হিন্দু বিবাহের পূর্বেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। বর এবং কনে উভয়কেই স্ব স্ব বাড়িতে গায়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করানো হয়। সারা দেহে তেল ও হলুদ মেখে সাবান দিয়ে তাদেরকে গোসল করানো হয়। গোসলের পূর্বে বরণ ডালা দিয়ে তাদেরকে বরণ করা হয়। বরণ ডালায় থাকে ধান, দূর্বা, পান, সুপারী, হলুদ বাটা এবং প্রদীপ শিখা। ভাবি, বোন, নানী, দাদীরা উপস্থিত থেকে গোসল বর অথবা কনেকে গোসল করিয়ে থাকেন। মা যদি সদবা থাকেন তাহলে প্রথমেই তিনি তার সন্তানের মুখে হলুদ মাখিয়ে গায়ে হলুদের উদ্বোধন করেন। কোন বিধবা এবং গর্ভবতী মহিলা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। গায়ে হলুদ পর্ব শেষে উপস্থিত সবাইকে খির দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। উপস্থিত সবাই বর বা কনেকে খির খাইয়ে দেন। বর বা খির খাইয়ে উপঢৌকন দেওয়ার রেওয়াজও আছে আমাদের সমাজে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে মেয়েলী গীতের প্রচলন আছে মাগুরার গ্রাম অঞ্চলে। 

বিবাহকালীন অনুষ্ঠানঃ মাগুরা অঞ্চলে নিজ নিজ ধর্মীয় বিধানমতে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানে বরযাত্রী আপ্যায়ন পাত্রীপক্ষের সামর্থকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বরযাত্রীদের আপ্যায়নের পাশাপাশি কনের বাড়িতে আতœীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে দাওয়াতের মাধ্যমে আপ্যায়ন একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। এই দাওয়াতে কনের জন্য উপঢৌকন একটি সামাজিক রেওয়াজ। এছাড়া বরের বাড়িতে বৌ নিয়ে যাওয়ার একদিন বা দু’দিন পর বৌভাত অনুষ্ঠানও একটি সামাজিক রীতি। এখানেও উপঢৌকনের ব্যবস্থা রয়েছে। 

গর্ভবতী রমনীকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানঃ গর্ভবতী কোন রমনী সপ্তম মাসে পদার্পন করলে তাকে স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে পাঠানোর রেওয়াজ রয়েছে আমাদের সমাজে। মাসের কোন একদিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম সাধ খাওয়ানো। আতœীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদেরকে নিমন্ত্রন জানানো হয়। গর্ভবতী রমনীকে নতুন পোশাক দেওয়া হয়। এসময়ও মেয়েলী গীতের প্রচলন আছে আমাদের সমাজে। সাধ খাওয়ানো উপলক্ষ্যে গর্ভবতী মহিলাকে হাতে কেটে বানানো সেমাই খেতে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে লোকবিশ্বাসও আছে আমাদের সমাজে। রান্না শেষে সেমাই প্লেটে রাখলে যদি উঁচু হয়ে থাকে তবে মনে করা হয় ছেলে সন্তান হবে, আর সেমাই যদি নিচু হয়ে থাকে তাহলে মনে করা হয় মেয়ে হবে। অন্যদিকে দু’টি ধামার একটির নীচে নেভানো আলগাবাতি আর একটিতে নোড়া রাখা হয়। তারপর গর্ভবতী রমনীকে একটি ধামা তুলতে বলা হয়। যদি সে নোড়ার ধামা তোলে তাহলে মনে করা হয় ছেলে হবে, অন্যদিকে বাতি হলে হবে মেয়ে। 

গর্ভাবস্থায় রমনীদেরকে ঘিরে থাকে অনেক লোক সংস্কার। বিভিন্ন ফকির কবিরাজের কাছ থেকে পানি পড়া এনে তাকে খাওয়ানো হয়, তেল পড়া এনে গায়ে মাখানো হয়, তাবিজ এনে হাতে পরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক পরিবারে এখনও গ্রাম্য ধাত্রী এনে সন্তান প্রসবের রেওয়াজ রয়েছে।  

সন্তানদের চুল কাটা অনুষ্ঠানঃ সন্তান প্রসবের পর পাঁচ-সাত দিন বয়সে মাথার চুল কাটা হয়। এসময় বাচ্চার মা, চাচী, নানী, দাদীসহ পাড়া প্রতিবেশিরা উপস্থিত থাকে। এসময়ও খির আপ্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। মেয়েলী গীতের প্রচলনও আছে মাগুরার গ্রাম্য অঞ্চলে।  

শিশুদের নামকরণ অনুষ্ঠানঃ নামকরণও শিশুকেন্দ্রিক একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। সচ্ছল পরিবারের লোকেরাই এই অনুষ্ঠানটি পালন করে থাকে। মুসলিম সমাজে আকিকা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নামকরণ করা হয় শিশুদের। তবে নাম রেখে পরবর্তীতৈও আকিকা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। আমাদের সমাজে আকিকার শাব্দিক অর্থ জানের বদলে জান উৎসর্গ করা। এ উপলক্ষ্যে গরু অথবা খাসী জবাই করে আতœীয়-স্বজন, গরীব-দুস্থ এবং পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে মাংশ বিতরণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ মাংশ তাদেরকে নিমন্ত্রন করে রান্না করে আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। 

সুন্নতে খাতনাঃ মুসলমান পরিবারের পুত্র সন্তানদেরকে সুন্নতে খাতনা বা মুসলমানি দেওয়া একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালন করা হয়। পুত্র সন্তানদের বয়স ৭/৮ বছর হলে পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া কর্তন করা হয়। এ ক্ষেত্রে হাজাম ডেকে এনে মুসলমানি দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে আতœীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশিদের দাওয়াত করা হয়। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগন খাতনা প্রাপ্ত সন্তানদের জন্য বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী নিয়ে আসেন। এ উপলক্ষ্যে আমাদের পাড়া গায়ে মেয়েলী গীতের প্রচলন রয়েছে।  

তথ্যপ্রদানকারীঃ

উম্মে হাবিবা নার্গিস

স্বামীঃ মোঃ নওয়াব আলী

গ্রামঃ সীতরামপুর

উপজেলা ও জেলাঃ মাগুরা

বয়সঃ ৪৪ বছর

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ বিএসসি

পেশাঃ শিক্ষকতা

জামাই ষষ্টিঃ বাঙালী সংস্কৃতিতে জৈষ্ঠ্য মাসকে মধু মাস বলা হয়ে থাকে। এমনটি বলার কারণ এ মাসে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি রসালো ফলের সমারোহ ঘটে। বাড়িতে বাড়িতে ফলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।  মাগুরা অঞ্চলের হিন্দু সমাজে প্রতি বাড়ির জামাইকে শ্বশুর বাড়িতে নিমন্ত্রন করে এনে জামাই-মেয়েকে নুতন কাপড় উপহার দেন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। জামাইকে আপ্যাায়ন করা হয় বিভিন্ন ফল, মিষ্টি ও মাছ-মাংস দ্বারা। মুসলিম পল্লীতে এই উপলক্ষ্যটা এত জাঁকজমক না হলেও জামাই বাড়িতে মধু মাসের ফল বিশেষ করে আম-দুধ পাঠানো হয়। 

গাশ্মীঃ গাশ্মী মাগুরা অঞ্চলের একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। আশ্বিন মাস যাওয়ার দিন এই পার্বনটি উদযাপন করে গ্রামের মানুষ। এই দিনে মাটিতে পুতে রাখা তালের আটি (বীজ) কেটে তার শাস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল-ডাউল তুলে তিনটি পথ  যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে খিচুড়ি রান্না করে খায় পাড়ার  মানুষ। 

এই দিনে মানুষের মাঝে একটি বিশেষ বুলি শোনা যায় তাহলোÑ        

                        ইয়ালী দুয়ালী ওরে আমার মা 

                        আয়ু থাকতি মরে গেলাম চোখে দেখলি না। 

ভোর বেলায় পাড়ার মহিলারা কুলো পেটায় আর বলেÑ     আশ্বিন যায় কার্ত্তিক আসে

                        মা লক্ষী গর্ভে বসে।

কেউ কেউ কুলো পিটিয়ে মশা তাড়ায় আর বলেÑ         এ বাড়ির মশা ও বাড়ি যা

                        কালুর মারে খুঁচে খা (যার সাথে শত্রæতা)   

নবান্ন উৎসবঃ অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। হেমন্তে ধান কাটার পর নতুন ধানের গন্ধে চাষীদের মুখে ফুটে ওঠে হাসির ঝিলিক। উৎসবের ধুম পড়ে যায় প্রতিটি বাড়িতে। আতœীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রন করে এনে মিষ্টি ও বিভিন্ন পিঠা দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। মসজিদে-মন্দিরে শিরনি দেওয়া হয়। বাড়িতে আগত আতœীয়-স্বজনকে নতুন পোষাক দেওয়ার রীতিও চালু আছে আমাদের সমাজে।                        

তথ্যপ্রদানকারীঃ

চন্ডীদাস বিশ্বাস 

বয়স ৫৬ বছর

শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ এম এ

পেশাঃ শিক্ষকতা

আলোকদিয়া, মাগুরা।

মন্তব্য: