1. সদর

মাগুরা সদরের লোক চিকিৎসা ও চিকিৎসক

আমাদের সমাজে  যেন রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা অনেক বেশী। কোন রোগী তার সমস্যার কথা বললে এমন কোন ব্যাক্তি নেই যিনি পরামর্শ দেন না। কেউ ডাক্তারের কথা বলেন, সে হতে পারে এ্যলোপ্যাথ কিংবা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। কেউ বা আবার যেতে বলেন ইউনানী কিংবা আয়ুর্বেদিক কিংবা হেকিমি কবিরাজের কাছে। কেউ আবার পরামর্শ দেন কোন ফকির বা সাধুর কাছে। জ্যেতিষিরাও কম যান না। ভাগ্য গননার মাধ্যমে মন্দভাগ্য ও বিভিন্ন সম্স্যার সমাধানও তারা দিয়ে থাকেন। এভাবেই চলে আমাদের সমাজে রোগ এবং রোগেীর চিকিৎসা। 

লোকজ চিকিৎসা কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। কেউ বলেন পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছি, কেউ বলেন স্বপ্নে পেয়েছি। কেউ আবার গুরুর মাধ্যমে এ চিকিৎসা শক্তি অর্জন করেন। কেউ আবার সাধনের মাধ্যমে অর্জন করেন চিকিৎসার কলাকৌশল। আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক ডাক্তারের চেয়ে এসব লোকজ চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। এবং সে সংখ্যা অসংখ্য বলা যায়। এসব চিকিৎসকের প্রতি মানুষের বিশ্বাসও অগাধ। 

মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে যে সব লোকজ চিকিৎসা ও চিকিৎসক চোখে পড়েছে তা নিম্নরূপঃ 

বিভিন্ন মসজিদের নামাজের শেষে দেখা যায় রোগীদের ভীড়। কেউ আসেন শিশু সন্তান নিয়ে, কেউবা আসেন নিজেই রোগী হয়ে। “হুজুর আমার মেয়েটা ভয় পেয়েছে, একটু ঝেড়ে দেন”। “হুজুর আমার ছেলেটার খাবারে রুচি নেই, একটু ঝেড়ে দেন”। এরকম নানাবিধ সমস্যা নিয়ে মানুষ আসে মসজিদের ইমামের কাছে। তাদের অগাধ বিশ্বাস হুজুর ফুুঁ দিলেই রোগ ভালো হয়ে যাবে। এটাকে অবশ্য লোকবিশ্বাসের আওতায়ও ফেলা যায়।  

তদবিরের কেরামতি বেশ জোরালোই, লোক বিশ্বাস দেখে বোঝা যায়। স্বামী বা স্ত্রীকে বাগে আনা, প্রেম বিষয়ে সফল হওয়া, অগাধ সম্পত্তি লাভের আশা, দুই সতীনের ঘরে সতীনকে বশে রাখা এবং স্বামীকে নিজের করে রাখা, শত্রæর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এরকম অসংখ্য বিষয়ে মানুষ ফকিরের কাছে তদবিরের জন্য যায়। 

জ্বিনে আসর করা ্মাদের সামাজে একটি লোক বিশ্বাস। বিশেষ করে সংসারের মেয়ে ও নারীদের উপরই যেন জ্বীনে আছর করে। কেউ বলেন, বেটিকে ভুতে ধরেছে। কেউ বলেন, পেতিœতে পেয়েছে ছেলেটাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবশ্য জী¡ন বা ভুতের পাওয়া লক্ষণের কোন ভিত্তি নেই। কোন মানুষ কোন প্রকার অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করলে বিশ্বাস করা হয় তার উপর জ্বিন আসর করেছে। ডেকে আনা হয় ফকির। ফকির তার মন্ত্র দিয়ে, হলুদ পুড়িয়ে জ্বীনকে কষ্ট দিয়েও জ্বীন তাড়াতে সক্ষম হন। অবশ্য অনেক হুজুরকেও জ্বীন তাড়াতে দেখা যায়। অবশ্য তাদের দাবি, তারা কোরানের আয়াতের মাধ্যমে জ্বীন তাড়িয়ে থাকেন। জ্বিন তাড়ানোর ক্ষেত্রে ফকির ও তার দল আসর বসিয়ে জ্বিনকে হাজির করেন। তারপর হাজিরকৃত জ্বিনের মাধ্যমেই জ্বিনে ধরা রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এসব আসরে ধুপ, আগরবাতি, বাতসা বিশেষ উপাদান। জ্বিন তাড়াতে আবার কেউ কেউ তেল পড়া, পানি পড়ে রোগীর চোখে মুখে ছিটিয়ে দেন। 

বন্ধ্যা মহিলাদের মাঝে লোক চিকিৎসার প্রতি অগাধ বিশ্বাস দেখা যায়। অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বিভিন্ন লোক-চিকিৎসক এসব মহিলাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন অনেক টাকা, কেউ শুধু ছাদগা নেন, কেউ বা আবার একেবারেই কোন কিছু নেন না। গুরুর নিষেধ মেনে চলতে তারা এই পন্থা অবলম্বন করেন। অবশ্য এ সংখ্যা অনেক কম। বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোন ফকির তন্ত্র-মন্ত্র প্রয়োগ করেন, কবিরাজ তার নিজস্ব উদ্ভাবিত ভেষজ ঔষধ প্রয়োগ করেন, জ্যোতিষি দেন বিভিন্ন প্রকারের আঙটি, হুজুর প্রয়োগ করেন কোরানের আয়ত, আর তাত্তি¡ক প্রয়োগ করেন কালী সাধনের মন্ত্র।   

আরেকটি রোগের ক্ষেত্রে লোক-চিকিৎসকরা অসহায়ত্বকে পুঁজি করেন। সেটা হলো যৌন রোগ। তবে যৌন রোগের ক্ষেত্রে ভেষজ প্রকৃতির লোক-চিকিৎসার প্রাচুর্যই দেখা যায়। 

পানি পড়া ও তেল পড়া লোক-চিকিৎসার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কখনো পড়া পানি পান করতে দেওয়া হয়। কখোন করতে দেওয়া হয় পড়া পানির গোসল। পড়া তেল গায়ে মাখতে দেওয়া হয়। 

তাবিজ লোকচিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ন উপাদান। আমাদের পাড়া গায়ে দেখা যায়, শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে কিন্তু গলায় ঝুলছে বিভিন্ন প্রকার তাবিজ। বয়স্ক মহিলাদের হাতে বাঁধা দেখা যায় তাবিজ। অনেককে আবার তাবিজ পরতে দেওয়া হয় মাজায়। তাবিজের মধ্যে কখনো লিখে দেওয়া হয় তদবির বা মন্ত্র, কখনোবা দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়া। তাবিজের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয় লোহা কিংবা তামা কিংবা রূপা।

সাপে কাঁটা রোগীকে দেখা যায় ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যেতে। ওঝাতেই যেন মানুষের বিশ্বাস। বারাশিয়া গ্রামের প্রয়াত ওঝা আজিজ মোল্যার পুত্র তৌহিদুজ্জামানকে দেখা গেল সাপে কাটা রোগীর বিষ নামাতে। তিনি বলেন, তার বাবার কাছ থেকে সাপের বিষ নামানোসহ অনেক প্রকার লোক চিকিৎসা মন্ত্র ও গাছগাছড়া রপ্ত করেছেন। এবং তিনি এসব চিকিৎসা বিনা পারিশ্রমিকে করে থাকেন। তৌহিদুজ্জামান তুলা রাশির এক মহিলাকে সাপে কাটা এক রোগীর সামনে বসিয়ে দিলেন। তারপর শুরু করলেন মন্ত্র পাঠ। তুলা রাশির হাত চলতে থাকলো ঐ মহিলার বিনা নিয়ন্ত্রনেই। হাতটিকে দেখা গেল সাপের বিষ রোগীর শরীরের যে পর্যন্ত উঠেছে, সে পর্যন্ত গিয়ে থেমে যেতে। তারপর হাতটি বিষ নামিয়ে আনলো রোগীর হাতের আঙ্গুলের মাথায়। অতঃপর ওঝা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে দিলেন রোগীর আঙ্গুল এবং লেবু কাঁটার সাহায্যে ছিদ্র করে দিলেন আঙ্গুলের মাথা। আঙ্গুল চেপে বিষ বের করে দেওয়া হলো লাউয়ের পাতায়। দিব্বি রোগী সুস্থ হয়ে উঠলো। তৌহিদুজ্জামান এর কাছে লোকচিকিৎসার প্রক্রিয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি কোরানের আয়াতের মাধ্যমে তিনি সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেন। তিনি ২২ বছর যাবৎ সাপের বিষ নামানোর চিকিৎসা করে আসছেন। 

কুকুরে কামড়ালে মানুষ লোকচিকিৎসকের সরণাপন্ন হয়ে থাকেন। কুকুরে কামড়ানো রোগীকে কোন চিকিৎসক লবণ পড়া ও গাছ-গাছালির সাহায্যে চিকিৎসা করেন। আবার অনেক চিকিৎসক গুড় অথবা পাটালী পড়ে কুকুরের বিষ নামান। কোন কোন চিকিৎসক  কুকুরে কামড়ানো স্থানে কাসার থালা বা বাটি লাগিয়ে মন্ত্র পাঠা অথবা কোরানের আয়াতের মাধ্যমে বিষ নামিয়ে চিকিৎসা করেন।    

মাগুরা অঞ্চলের মানুষের মাঝে আর একটি প্রথা চালু রয়েছে। সেটি হলো মানত করা। মানত করার রেওয়াজ রয়েছে মুসলমান ও হিন্দু উভয় সমাজেই। ইছাখাদা পাীর মুকররম আলী শাহ এর মাজারে গিয়ে দেখা গেল সেখানে হাজারো মানুষের সমাগম। তারা বিভিন্ন সমস্যার জন্য মানত করেছিল পীর সাহেবের দরগায়। মানত এর মধ্যে থাকে শিরনী, মুরগী বা খিচুড়ি রান্ন করে দরগাহ মাদ্রাসার ছেলেদেরকে খাওয়ানো। কেউ আসে মানত করে শিশুদের মুখে ভাত দেওয়ার জন্য। কেউ মুরগী বা ছাগল মানত করে দরগায় এনে ছেড়ে দেন। বারাশিয়া গ্রামে রয়েছে একটি বিশাল বটগাছ। এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল এই বটগাছের ডাল কেউ কাটে না, এমনকি পাতাও কেউ পোড়ায় না। কেউ এমন কাজ করলে গলা দিয়ে সে রক্ত উঠে মারা যায় কিংবা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হয়। এই বট গাছের গোড়ায় মানুষ মানত করে এখানে গাছের দুগ্ধস্নান করায়। এলাকাবাসী জানায়, সেন আমলে তিঁতুধার গোসাই নামে এক সাধক ছিলেন। তিনিই বটগাছটি উল্টো লাগিয়েছিলেন।  এবং এই বটগাছের নীচে তিনি তপস্যা করতেন।   

মাগুরা শহরের সাহা পাড়ার মৃত ওঝা হেমেন সাহার পুত্র মনিমোহন সাহার সাথে কথা বললে তিনি বলেন তার বাবার কাছে এমন সাপে কাটা রোগী আসতো যাকে হাসপাতাল থেকে মৃত বলে ঘোষণা করা হতো। কয়েকবার এমন ঘটনা তিনি দেখেছেন। মনিমোহন সাহা নিজেও সাপে কাটা রোগীর বিষ নামিয়ে থাকেন। এছাড়া তিনি মন্ত্রের সাহায্যে তেল পড়া ও পানি পড়ার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার বাতের চিকিৎসা করেন। এ চিকিৎসা করতে তিনি কোন প্রকার টাকা পয়সা নেন না। মাগুরা জেলাসহ দেশের বিভিন্ন দূরবর্তী জেলা থেকে রোগীরা আসেন তার কাছে চিকিৎৎসার জন্য। তিনি সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, যতদিন জীবিত থাকবেন, ততদিন তিনি বিনামূল্যে রোগীদের সেবা দিয়ে যাবেন। এটা তার পিতার নির্দেশ।  

রামনগর ঠাকুরবাড়ির বাসিন্দা মাখন বিশ্বাসের ভেষজ চিকিৎসায় এলাকায় বিশেষ সুনাম রয়েছে। ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে তিনি ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর চিকিৎসা করেন। এছাড়াও ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে পুরুষ ও মহিলাদের যৌন রোগ ও বন্ধ্যাত্ব রোগের চিকিৎসা করেন।

ইছাখাদা গ্রামের বাবর আলী নিজের উদ্ভাবিত গাছ-গাছড়ার ঔষধের মাধ্যমে ভেষজ চিকিৎসা করেন। একই গ্রামের ফকির ছব্দুল মোল্যা ও খোকন মোল্যা লোকচিকিৎসক ও কবিরাজ। মন্ত্রের মাধ্যমে তারা সাপের বিষ নামান। ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে নারী-পুরুষের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন।  

দক্ষিণ মির্জাপুর পিকুল হোসেন দেশজ গাছের সাহায্যে ঔষধ     তৈরী করেন ও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এলাকায় তাদের বেশ সুনাম রয়েছে।

ডাঃ ওসমান গনি মোল্যা ১৯৪৬ সাল থেকে কবিরাজীতে পাশ করার পর থেকে মানুষের চিকিৎসায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। হোমিওপ্যাথী, এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায়ও সমান জুড়ি রয়েছে। তদবীরের সাহায্যেও চিকিৎসা করে থাকেন। গ্রাম্য লোকচিকিৎসক হিসাবে তার সুনাম আছে দেশব্যাপী। প্যারালাইসিস, জন্ডিস, মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব রোগের     চিকিৎসাই বেশি করেন।  দেশজ গাছের সাহায্যে নিজেই যৌনরোগ, ঘাঁ ও বাতের ঔষধ তৈরী করেছেন। ১১৫ বছর বয়সেও তিনি বিভিন্ন জেলার মানুষের ঔষধি চিকিৎসাসহ লোক চিকিৎসা দেন। 

রূপাটি গ্রামের সাপুড়িয়া মোঃ লুৎফর রহমান, ওঝা সাপের বিষ নামান মন্ত্র ও গাছের সাহায্যে। এলাকায় তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। জাগলা গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পুত্র কৃষ্ণপদ মন্ডল, সাপ অথবা কুকুরে কামড়ালে গাছগাছালি ও মন্ত্রের সাহায্যে বিষ নামান।

মন্তব্য: