1. লোক

মাগুরা অঞ্চলের লোক-ক্রীড়া

লাঠিখেলাঃ লাঠিখেলা তিন প্রকারের রয়েছে। সাজের খেলা, কাযের খেলা ও বাড়ির খেলা। লাঠিখেলা শুরুর পূর্বে খেলোয়াড়গন তাদের গুরুর পায়ে প্রনাম করে নেন। তারপর উপস্থিত খেলোয়াড়গন সবাই একসাথে আল্লাহ ও নবী-রসুলের বন্দনা করে নেন। লাঠিখেলা যেটি সাজের জন্য খেলা হয়, তারজন্য লাঠিখেলোয়াড় লাঠির কলাকৌশল প্রদর্শন করেন। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি লাঠি, তারপর দুটি, তিনটি, চারটি, পাঁচটি লাঠি একসাথে খেলার বিভিন্ন আকর্ষণীয় নৈপুন্য প্রদর্শন করেন উপস্থিত খেলোয়াড়গন। দ্বিতীয় প্রকারের খেলা হলো কাযের খেলা। লাঠি খেলোয়াড় ও কাযের খেলোয়াড়দেরকে সর্দার বলা হয়। কাযের খেলায় কাযে পরিচালনা করার জন্য লাঠির যে কলাকৌশল তাই প্রদর্শন করা হয়। এক্ষেত্রে খেলোয়াড়েরা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে লাঠি দ্বারা খোঁচা মারার চেষ্টা করেন এবং ইয়া আলী শব্দ উচ্চারণ করেন।  যারা বেশি খোঁচা মারবেন তাদেরকেই বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হয়। তৃতীয় প্রকারের খেলঅ হলো বাড়ির খেলা। লাঠির প্যাচের মাধ্যমে একপক্ষের খেলোয়াড় অন্য পক্ষের খেলোয়াড়কে বাড়ি মারতে (আঘাত করা) চেষ্টা করেন। যে খেলোয়াড় যত বেশি বাড়ি মারতে পারবেন তিনিই বিজয়ী হবেন। 

মাগুরার বিভিন্ন এলাকায় লাঠিখেলার প্রচলন রয়েছে। বলা যায় লাঠিখেলাই মাগুরা অঞ্চলের প্রধান লোকজ খেলা। বিভিন্ন মেলায় লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। আবার লাঠিখেলা উপলক্ষ্যেও মেলা বসে বিভিন্ন এলাকায়। লাঠিখেলার প্রচলন রয়েছে হাজীপুর গ্রামে। এ গ্রামের উল্লেখযোগ্য লাঠি খেলোয়াড় যাদেরকে সর্দার বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা হলেন নজর আলী, আঃ রহীম ও বজলু সর্দার। কছুন্দি ইউনিয়নে আগে লাঠি খেলার ব্যপকতা থাকলেও হারিয়ে যেতে বসেছে এই আনন্দমুখর খেলাটি। এলাকার উল্লেখযোগ্য লাঠি খেলোয়াড় হলেন বেলনগর গ্রামের হবিবর রহমান সর্দার, ছবেদ আলী সর্দার ও তছিরুদ্দিন বিশ্বাস। 

লাঠিখেলা ও কাযেকে কেন্দ্র করে পুখরিয়া গ্রামে সর্দার পাড়া রয়েছে। তথ্যসূত্রে জানা যায়, পুখরিয়ার সর্দারদের পূর্বপুরুষের পুখরিয়া গ্রামে আগমন ঘটে কছুন্দি ইউনিয়নের বেলনগর গ্রাম থেকে। এই সর্দারদের পূর্বপুরুষ ছিল শেখ গোষ্ঠির অন্তর্গত। এই গোষ্ঠির কিছু অংশ ভায়না গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের বংশ পরিচয় শেখই রয়েছে। কিন্তু     পুখরায় আগত শেখরা লাঠিখেলা ও কাযেতে পারদর্শি হওয়ার কারণে তারা শেখ বংশ থেকে হয়ে যায় সর্দার বংশের।     পূর্বপুরুষদের মধ্যে আব্দুল সর্দার, বামরেজ সর্দার ও মোকাররম সর্দার ছিলেন তিন ভাই। এই তিনজনের পরবর্তী বংশধর     বংশপরম্পরায় হয়ে ওঠে অত্র অঞ্চলের দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল ও কাযেবাজ। পুখরিয়ার সর্দারদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্থ থাকতো অন্যান্য গ্রামের বাসিন্দারা। সর্দারদের পরবর্তী প্রজন্ম মনির উদ্দিন সর্দার, রজব আলী সর্দার, ছবেদ সর্দার, ইয়ার উদ্দিন সর্দার, ওয়াহেদ সর্দার, ছামাদ সর্দার, হাদান সর্দার, নিজাম সর্দার,রায়হান সর্দার, ইসমাইল সর্দার, খালেক সর্দার, রাজ্জাক সর্দার, ইজ্জাতুল্লা সর্দার, তেজারত সর্দার, নুরুল সর্দার, শামছেল সর্দার, কাফিল উদ্দিন সর্দার, ছামির সর্দার, ইজাহার সর্দার প্রমুখ ব্যাক্তিরা লাঠিখেলা ও কাযেতে অনেক সুনাম অর্জন করেন। সর্দারদের এই লাঠিয়াল হওয়ার পেছনে কারণও রয়েছে।     মধুমতি নদীতে জেগে ওঠা চর দখলকে কেন্দ্র করে পুখরিয়া, চরপুখরিয়া, বাগবাড়িয়া, বকশিপুর ও গয়েশপুর গ্রামের মানুষ সারাবছর কাযে-দাঙ্গায় ব্যস্ত থাকতো। সর্দার পাড়ার লাঠিয়ালরা কাযেতে বাঁশের লাঠি, ঢাল ও সড়কি ব্যবহার করতো। সর্দারদের মধ্যে গোত্র বিভক্ত হয়েও সারাবছর কাযে চলতো। আবার এসব লাঠিয়ালরা  লাঠিখেলায় উপভোগ করতো উৎসবমুখর আমেজ। এ সমস্ত লাঠিয়াল লাঠিখেলায় ও কাযেতে ভাড়াটিয়া হিসাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় ভাড়াটিয়া হিসাবে যেত এবং এর মাধ্যমেই তাদের জীবীকা অর্জন করতো। কিন্তু কাযের সেই যৌলুশ নেই এখন। ঢাল সড়কির ব্যবহারও কমে গিয়েছে। তবে লাঠিখেলার প্রচলন এখনও রয়েছে ইউনিয়নব্যপি। পুখরিয়া গ্রামে আশ্বিন মাসের শেষ দিন এবং আলোকদিয়া গ্রামের পীরসাহেব মরহুম জাফর সাদেক এর বাড়িতে কার্ত্তিক মাসের দ্বিতীয় দিনে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। এই লাঠিখেলায় কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলার লাঠিখেলোয়াড়রা অংশগ্রহন করেন। এছাড়া বারাশিয়া গ্রামেও মাঝেমাঝে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। বারাশিয়া গ্রামের লাঠিখেলার দলনেতা হলেন মোঃ আবুল কালাম মোল্যা। তার নেতৃত্বে অন্যান্য খেলোয়াড়রা হলেন বাচ্চু সর্দার, আবু তালেব সর্দার, ওলিয়ার সর্দার ও কেছমত সর্দার। এসব খেলোয়াড়রাও ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় লাঠিখেলায় অংশগ্রহন করেছেন।

                        তথ্যঃ কমির সর্দার, সদস্য, সর্দার গোষ্ঠি, পুখরিয়া, মাগুরা

প্রতিবছর হেমন্তের নবান্নের উৎসবে ইছাখাদা ও হাজরাপুর গ্রামে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়।শীত মৌসুমে বেরোইল গ্রামে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয় এই খেলায় মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলার লাঠি খেলোয়াড় অংশগ্রহন করে। 

আরবি সনের প্রতি মর্হরম মাসে ১১ তারিখে মঘী গ্রামে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। এই লাঠিখেলায় অংশগ্রহনকারী শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়কে পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হয়। মঘী ইউনিয়নের লাঠিখেলার উল্লেখযোগ্য সর্দার হলেন ছত্তার মোল্যা, ছালেক মোল্যা, সিরাজ মোল্যা ও ধলা শিকদার। অন্যান্য খেলোয়াড়রা হলেন মঘী গ্রামের গঞ্জর আলী, তুজাম ইসলাম, নান্নু, শহীদ, আলা, হাফিজার প্রমুখ।

চাউলিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। কার্ত্তিক মাসের প্রথম দিন লঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। মৃত কাশেম সর্দার ( বুজরুক শ্রীকুন্ডি), মৃত খোরশেদ মন্ডল (বুজরুক  শ্রীকুন্ডি), মৃত হাতেম সর্দার (মালিকগ্রাম), মৃত ইমারত সর্দার (চাঁদপুর), বেলায়েত আলি সর্দার (চাঁদপুর) ইউনিয়নের বিশিষ্ট লাঠিখেলোয়াড় ছিলেন। কাযে ও লাঠিখেলায় পারদর্শি গ্রাম চাঁদপুর। বর্তমানে আকবর সর্দার (চাঁদপুর), আউয়াল সর্দার (ঐ), বসির সর্দার (ঐ), নবীর সর্দার (ঐ), সোহরাব সর্দার (ঐ) মাগুরা জেলার হেড সর্দার রায়গ্রাম গ্রামের শওকত সর্দার এর নেতৃত্বে জেলার বিভিন্ন এলাকায় লাঠিখেলা করে। এই গ্রæপ ঢাকায় থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত। একই ইউনিয়নের বুজরুক শ্রীকুন্ডির বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর কার্তিক মাসে শত্রæজিৎপুরের কুটি মিয়ার বাড়িতে লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নের কুল্লিয়া মেলায় লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয় ।

নৌকা বাইচঃ মাগুরা সদর উপজেলাটি নদীবেষ্টিত হওয়ার কারণে নৌকাবাইচ আয়োজনে জমজমাট হয়ে ওঠে বিভিন্ন অঞ্চল। নৌকাবাইচের জন্য জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বাইচের নৌকার সমারোহ ঘটে।  দুই ধরণের নৌাকর বাইচ হয়। ছোট নৌকাগুলোতে ৫/৬ জন আরেহী থাকে। অপরদিকে বড় নোকাগুলোতে ৭০/৮০ জন আরোহী থাকে। মাগুরা জেলার বাইরে থেকেও বাইচের নৌকা আসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্য। নৌকাবাইচের জন্য নৌকার আকৃতি অনুযায়ী আরোহী সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। নৌকার দুই পাশে দুই সারি আরোহী থাকেন যারা বৈঠার সাহায্যে নৌকাটিকে প্রতিযোগিতার জন্য দ্রæততার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেন। তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য একজন দলনেতা থাকেন যিনি সর্বক্ষণ উৎসাহ প্রদানের কাজটি করে যান। উৎসাহ দানের জন্য তিনি বিভিন্ন প্রকার গানের আশ্রয় নেন। গানের সাথে থাকে কাশি, বাঁশি ও ঝুমুর তালে তালে বৈঠা বইবার জন্য।  নৌকাবাইচে অংশগ্রহনকারী প্রতিটি দল স্বতন্ত্র দলীয় পোশাক পরিধান করে।  

বেশ আগে হাজীপুর গ্রামে নৌকাবাইচ হতো। কিন্তু জলাশয়ের স্বল্পতার কারণে এখন আর নৌকাবাইচ হয় না।  চাউলিয়া ইউনিয়নের সিরিজদিয়া বাওড়ে সাঁতার প্রতিযোগিতা ও নৌকাবাইচ অনুষ্টিত হয়। বেরোইল পলিতা গ্রামে নবগঙ্গা নদীতে অনিয়মিত নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। কুচিয়মোড়া নবমীর মেলায় নৌকাবাইচ হয় ফটকী নদীতে।

হাডুডুঃ হাডুডু খেলা আমাদের দেশের জাতীয় খেলা হলেও এর ব্যাপ্তি লোকজ ক্রীড়া হিসাবেই। শহর অঞ্চলে এ খেলাটির তেমন কদর না থাকলেও গ্রামাঞ্চলে হাডুডু খেলা মানুষকে আনন্দ দানের একটি অসাধারণ রসদ। মাগুরা অঞ্চলে হাডুডু খেলাটি টেকটেক খেলা নামেও পরিচিত। বিভিন্ন মেলায় হাডুডু খেলার আয়োজন করা হয়। অথবা শুধু হাডুডু খেলাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয় উৎসবীয় আমেজ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মাঝে। জাতীয় খেলা হওয়ার কারণে হাডুডু খেলার নিয়ম সারাদেশে একই ধরণের। 

নিকট অতীতে মাগুরা সদর উপজেলার ুহাজীপুর ইউনিয়নে হাডুডু খেলায় মেতে উঠতো এলাকাবাসী। কিন্তু কোন ধরনের গোলমাল এড়াতে খেলাটি এখন এলাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। বগিয়া ইউনিয়নের বারাশিয়া, পাইকেল ও আলোকদিয়া গ্রামে হাডুডু খেলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাপক আয়োজনে ইছাখাদা তালতলায় হাডুডু খেলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। 

মঘী ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে হাডুডু খেলায় মেতে ওঠে এলাকবাসী। শেখপাড়া গ্রামের বাদশা মোল্যার নেতৃত্বে হাডুডু দলটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাডুডু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে। বেরোইল পলিতা গ্রামে বিভিন্ন সময়ে হাডুডু খেলায় মেতে ওঠে এলাকাবাসী। কুচিয়ামোড়া ইউনিয়নে বিভিন্ন সময়ে হাডুডু খেলায় মেতে ওঠে এলাকাবাসী। 

সাপখেলাঃ শীত মৌসুমে রাঘবদাইড় ইউনিয়নের বেরোইল গ্রামে প্রদর্শিত হয় ঝাপান খেলা। এই খেলায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত সাপুড়িয়াগন উপস্থিত করে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। তারা উপস্থাপন করে সাপের বিভিন্নরকম খেলা। মাগুরা সদর উপজেলাধীন নিজনান্দুয়ালী গ্রামের মরহুম আবেদ মিয়ার পুত্র মোঃ মজনু মিয়া ৪০ বছর যাবৎ সাপখেলা দেখিয়ে জীবীকা নির্বাহ করেন। ৫৫ বছর বয়সী মজনু মিয়া নিজে সাপ ধরেন এবং গাছের সাহায্যে সাপের বিষ নামান। গোখরা, কেউটে, মেছো আওলাদ, অজগর, দাড়াস, দুধরাজ, বিজপুড়ি, টিয়াটুঠি প্রজাতির সাপ ধরেছেন এ যাবৎ। এগুলোকে তিনি পোষ মানান। ধৃত সাপদেরকে তিনি ব্যাং, ইঁদুর, মুরগী, ডিম খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। দুধ খাওয়ান দাড়াস সাপকে। তিনি জানান, সাপ খোলস ছাড়ে ১৫ দিন পর পর। তিনি সাপ ধরেন গাছের সাহায্যে। খেলা দেখাতে গিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার সাপের কামড় খেয়েছেন। নিজেই গাছের সাহায্যে বিষ নামিয়েছেন। তার জানা মতে, মাগুরার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সাপুড়িয়া ছিলেন বরুনাতৈল গ্রামের আকমল ও মালেক, জাগলা গ্রামের ছত্তার, রুপাটি গ্রামের রফিক, শত্রæজিৎপুর গ্রামের নুরো, গাংনালিয়া গ্রামের ছেকেন। এরা সবাই সাপড়ের কামড়ে মারা গিয়েছেন। মজনু মিয়ার সাপ ধরার ওস্তাদ কছুন্দি গ্রামের মোঃ রাশেদ মীর এখনও জীবিত আছেন। মজনু মিয়া জানান, আগের মতো আর জনপ্রিয় নেই সাপ খেলা। সাপুড়ে পেশায় নতুন কেউ আসছেও না। তিনি সারা বাংলাদেশে সাপ খেলা দেখান। ঢাকা ও চট্টগ্রামে খেলা দেখাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি দর্শকের সমাগম দেখেছেন তিনি। গ্রাম এলাকার চেয়ে শহর এলাকায় বেশি লোক সমাগম হয় সাপ খেলা দেখানোর সময়, তিনি জানান। 

ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাঃ ঘৌড়দৌড়কে গ্রামাঞ্চলে ঘোড়া দাবড়ের অনুষ্ঠান বলা হয়। শুধুমাত্র ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় লোকজ মেলা। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আনা হয় রকমারী ঘোড়া। ঘৌড়দৌড় শুরুর প্রাক্কালে প্রতিটি ঘোড়াকে প্রতিযোগিতার সর্বশেষ সীমানা চিনিয়ে আনেন প্রতিযোগিরা। প্রতিযোগিতা শুরুর সময় প্রতিটি ঘোড়াকে সারিবেধে দাড় করিয়ে দেওয়া হয়। সওয়ার হিসাবে ঘোড়ায় বসিয়ে দেওয়া হয় কিশোর বয়সের ছেলে। সওয়ারের দু’হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় দু’টি ছড়ি। মুখে থাকে বাঁশি। বালকটি দু’হাতের ছড়ি দিয়ে ঘোড়াটিকে আঘাত করতে থাকে এবং বাঁশি বাজাতে থাকে আর ঘোড়াটি ছুটতে থাকে।   

প্রতিবছর ফালগুন মাসে রাঘবদাইড় ইউনিয়নের ধনপাড়া গ্রামে ঘেড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা সনের প্রতি অগ্রহায়ন মাসের ২৮ তারিখে মঘী গ্রামে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জগদল ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামে শীতকালে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর ধলহরা গ্রামে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।২৯ পৌষ বড় শলই গ্রামে, ২০ পৌষ আমুড়িয়া গ্রামে, ১৪ ফাল্গুন গাংনি গ্রামে এবং অনির্ধারিত সময়ে কুল্লিয়া গ্রামে লোকজ মেলা অুনষ্ঠিত হয়। এই মেলাগুলোতে ঘোড়দৌড় অনুষ্ঠিত হয়। ২৮ পৌষ গোপালগ্রাম ইউনিয়নের বাহারবাগ গ্রামে অনুষ্ঠিত ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। এছাড়া পহেলা পৌষ বাহারবাগ পশ্চিমপাড়ায় এবং ফাল্গুন মাস যাওয়ার দিন বাহারবাগ দক্ষিণ পাড়ায় ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। 

এছাড়া মাগুরা সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নিম্নবর্ণিত গ্রামীণ খেলাগুলো কিশোর-কিশোরীরা খেলে থাকে। তবে খেলাগুলোর জৌলুষ ক্রমইে হারিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল সংস্কৃতি ও কম্পিউটার আমাদের এই আকর্ষণীয় গ্রামীণ খেলাগুলোকে ক্রমশঃ ¤øান করে দিচ্ছে।

দাড়িয়াবান্ধাঃ দাড়িয়াবান্ধা গ্রামে অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় লোকজ ক্রীড়া ছিল। এটি বর্তমানে দেখা যায়না বললেই চলে। এই খেলায় তিন এর অধিক  কোর্ট থাকে। প্রথম কোর্টকে মাঝখানে দুভাগ করা। দু’ভাগের একটি কোর্টে এক দলকে আটকে রাখার চেষ্টা করে আর এক দল। লম্বা সারিতে এবং প্রতিটি আড়াআড়ি সারিতে এক একজন করে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে দাড় করিয়ে রাখা হয়। সবাই চেষ্টা করে এক একজন বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে আটকে রাখতে। যদি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা একজনকেও আটকে রাখতে না পারে তবেই পক্ষ দলকে জয়ী বলে ধরা হয়। যদি একজনও বাকি থেকে যায় তাহলে খেলা সম্পন্ন হয় না। পক্ষদল তখন রক্ষকের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। এভাবেই চলতে থাকে এক এক পর্ব এবং এক এক গেম। 

নাথিং ঠকঃ একটি ছোট গর্ত করে সেই গর্ত কেন্দ্রিক মার্বেল খেলাকে নাথিক ঠক বলে। দু’জন খেলোয়াড় থাকে এ খেলায়। একজন খেলোয়াড়ের উদ্যেশ্য থাকে ডান হাতের মধ্যমা আঙ্গুলে বলটি ধরে অন্য হাতের  সাহায্যে বলটিকে গর্তের ভেতর পাঠানোর চেষ্টা করবে। বল গর্তে না গেলে অন্যজন একইভাবে বলটি ধরে তার বলটিকে আঘাত করে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে। যদি প্রথম খেলোয়াড় বলটিকে গর্তে প্রবেশ পারে তাহলে সে আঘাতকারীর ভ‚মিকায় অবতীর্ন হবে। এক্ষেত্রে বল আঘাতকারী এক একটি আঘাত করে আর এক একটি শব্দ উচ্চারণ করে। তাহলোÑ

একে ইঁন্দুর, দুইয়ে দাঁতাল, তিনে তেলী, চারে চোর, পাঁচে পেঁচা, ছয়ে ছুঁচো, সাতে শালিক নাচে, আটে পানতা ঘাটে, নয়ে নাপিত, দশে দামড়া, এগারোয় হোল কামড়া, বারোয় বুড়ো বান্দর, তেরোয় তেন্দড়, চৌদ্দয় বিয়ের চাঁদর, পনেরোয় পান খায়, ষোলয় গান গান গাই, সতেরোয় সাত ইঞ্চি, আঠারোয় এসো, উনিশে বসো, বিশে বিয়ে। এভাবে বিশ পর্যন্ত পূর্ণ হলে এক গেম ধরা হয়। 

ডাঙ্গুলিঃ এ খেলার অপর নাম গুলবাড়ে। ডাঙ্গুলি খেলায় দু’জন খেলোয়াড় থাকে। এ খেলার উপকরণ হলো একটি ডাং এবং অন্যটি হলো গুলি। কোনাকৃতির ছোট একটি গর্ত করা হয় এ খেলায়। প্রথম খেলোয়াড় তার ডাং এর সাহায্যে গুলিটি উঁচু করে দূরে ছুঁড়ে মারে। যদি দ্বিতীয় খেলোয়াড় গুলিটি ধরতে পারে তাহলে সে প্রথম খেলোয়াড়কে বলবে, ‘বলো উলা’ প্রথম খেলোয়াড়টি বলবে ‘উলা’, তখন দ্বিতীয় খেলোয়াড় বলবে, ‘গুদি কুলা’। কিন্তু দ্বিতীয় খেলোয়াড় যদি গুলিটি ধরতে না পারে তাহলে সে গুলিটিকে ছুঁড়ে মেরে গর্তের এক হাতের মধ্যে রাখার চেষ্টা করবে। গর্তের এক হাতের মধ্যে গুলিটি পড়লে প্রথম খেলোয়াড় ফিল্ডার এর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হবে। যদি গর্ত থেকে এক হাতের বেশি দূরে গুলিটি পড়ে তাহলে প্রথম খেলোয়াড় ডাঙ দিয়ে দূরত্ব মেপে নেবে। এভাবে চলতে থাকবে মাপার প্রক্রিয়াটি যতক্ষন না পর্যন্ত একশ ডাং এ না পৌছায়। একশত ডাং হলে প্রথম খেলোয়াড় দ্বিতীয় খেলোয়াড়কে বলতে বলবে ‘বলো উল’. দ্বিতীয় খেলোয়াড় বলবে ‘উল’ তখন প্রথম খেলোয়াড় বলবে ‘গুদি কুল’। মাগুরা অঞ্চলের ছেলেরা এ খেলায় মেতে থাকতো দুপুর-বিকেল। কিন্তু অনেক কমে গেছে এ খেলার প্রচলন।  

গাদনড়ীঃ নরম মাটিতে লাঠি গেঁথে খেলার নাম গাদনড়ি খেলা। এক্ষেত্রে দুয়ের অধিক খেলোয়াড় থাকে এবং প্রত্যেক খেলোয়াড়ের কাছে থাকে একটি করে লাঠি। লাঠির একপ্রান্ত সরু করে দেওয়া হয় যাতে এটি মাটিতে গাঁথা যায়। প্রথমে একজন খেলোয়াড় মাটিতে তার লাঠি গেঁথে দেয়। তারপর ঐ লাঠিটিকে অন্য খেলোয়াড়ের লাঠি দ্বারা আঘাত করা হয়। নিয়ম হলো যে লাঠি গাঁথবে, তার লাঠিটা মাটিতে পুতে থাকতে হবে এবং অন্য লাঠিটি যদি আঘাতে পড়ে যায় তবে লাঠিটি আঘাতকারীর হয়ে যাবে এবং যার লাঠি সে পঁচে যাবে। এবার বাকি কয়জনের মধ্যে খেলা চলতে থাকবে। খেলা শেষে সব লাঠি যখন একজনের হয়ে যাবে তখন সে লাঠিগুলো ছুঁড়ে মারবে দৃষ্টির আড়ালে। তারপর যে যার লাঠি খোঁজ করে আনবে। যে সবার পরে লাঠি খুঁজে উপস্থিত হবে, পূনরায় খেলা হলে সে সবার প্রথমে লাঠিটি মাটিতে গাঁথবে।    

কানামাছিঃ আমাদের পাড়া গায়ের ছেলে মেয়েরা বিকেল বেলায় মেতে উঠতো এই খেলায়। খেলার শুরুতেই লটারীর মাধ্যমে একজনকে চোর বানানো হয়। তার পর তার চোখ বেধে তাকে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করতে থাকে প্রতিপক্ষরা। যদি সে কাউকে ধরে নাম বলতে সক্ষম হয় তবে সে মুক্ত। যাকে ধরা হবে সেই হবে নতুন চোর। এভাবেই চলতে থাকে একজনের পর আরেকজনের পালা।  

চিঁ বুড়িঃ চিঁ বুড়ি খেলার ক্ষেত্রে প্রথম দলের কাছে থাকে বুড়ি (বুড়ির প্রতীকী ছেলে বা মেয়ে)। দ্বিতীয় দলের একজন করে খেলোয়াড় যাবে বুড়িকে উদ্ধার করতে। প্রথম দলটি বুড়িকে রক্ষা করার চেষ্টা করবে। বুড়িকে উদ্ধার কাজে যদি দ্বিতীয় দলের খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে দেয় প্রথম দলের খেলোয়াড় তবে দল ঘুরে যাবে। বুড়িকে উদ্ধার করতে গিয়ে দ্বিতীয় দলের খেলোয়াড় এক নিঃশ্বাসে চি উচ্চারণ করবে। যদি  সে প্রথম দলের কাউকে ছুঁতে পারে তবে সে পঁচা খেলোয়াড় হিসাবে গন্য হবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এই খেলাটির মাধ্যমে খুব আনন্দ পেয়ে থাকে। বুড়িকে উদ্ধার করতে পারলে সে দল জয়ী হিসাবে গন্য হবে। 

গোল দি গোলঃ গোল করে একটি গর্ত করা হয়। গর্তের মধ্যে একদল এবং গর্তের উপরে থাকে আরেক দল। উভয় দলই চায় তাদের দলে লোক বাড়াতে। হাত ধরে কাউকে নামাতে পারলেই তাকে কিলোতে থাকে প্রতিপক্ষরা এবং তাকে বলানোর চেষ্টা করে গোল বলাতে। যদি বলে গোল তবে সে তাদের দলের হয়ে যাবে। যে দল প্রতিপক্ষ সবাইকে দলে ভিড়াতে পারবে সেই দলই জয়ী হবে। এটিও আমাদের অঞ্চলে একটি লোকজ ক্রীড়া। 

বৌচিঃ বৌচি খেলাটি চিঁ বুড়ি খেলার অনুরূপ। তবে এ খেলায় বুড়ির স্থানে মাটির চাড়া রাখা হয়। এই চাড়াটিকে বৌ এর প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। এই বৌকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় চিঁ বুড়ি খেলার নিয়মেই খেলাটি চলতে থাকে দু’দলের মধ্যে। 

গোল্লাছুটঃ একটি বড় বৃত্তের মধ্যে এক দলের খেলোয়াড়রা হাতে হাত ধরে ঘুরতে থাকে। আর ছুটতে থাকা অন্য দলের খেলোয়াড়দেরকে ছুঁতে চেষ্টা করে। যদি কেউ ছোঁয়া পড়ে যায় তাহলে সে পঁচা খেলোয়াড় হিসাবে গন্য হয়। ঘুরতে ঘুরতে এক একজন খেলোয়াড় ছুটে যায় বৃত্তের বাইরে। যদি সে ছোঁয়া পড়ে যায় তাহলে সে পঁচা খেলোয়াড় হিসাবে গন্য হয়। ঘুরতে থাকা খেলোয়াড়রা সবাই যদি বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয় তাহলে সেই দল জয়ী হিসাবে গন্য হয়। মাগুরা অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ির উঠোনে ছেলেমেয়েদেরকে এই খেলাটি খেলতে দেখা যায়। 

হোল-ডুগঃ হোল-ডুগ খেলাটি খেলে আমাদের পাড়া গায়ের ছেলে-মেয়েরা নদী, পুকুর কিংবা খালে গোসলের সময়। এ খেলায় একজন থাকে চোর। তাকে পানিতে ডুব দিয়ে পালাতে থাকা অন্য খেলোয়াড়দের যে কোন একজনকে ছুঁতে হয়। যে ছোঁয়া পড়বে সেই হবে নতুন চোর। সে আবার অন্যদেরকে ছুঁয়ে চোর হওয়া থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবে। এভাবেই খেলাটি চলতে থাকে। 

কপাল ঠোকাঠুকিঃ কপাল ঠোকাঠুকি খেলায় মাঠের দু’পাশে দুদল খেলোয়াড় থাকে। দু’দলে থাকে দুজন দলনেতা। এক পক্ষের দলনেতা অনপক্ষের একজন খেলোয়াড়ের চোখ আটকে রাখে এবং একজন খেলোয়াড়কে ছদ্মনামে ডাকে। ছদ্মনামধারী খেলোয়াড়টি এসে চোখ আটকে রাখা খেলোয়াড়ের কপালে টোকা দিয়ে নিজের যায়গায় চলে যায়। তারপর চোখ আটকে রাখা খেলোয়াড়ের চোখ খুলে দেওয়া হয় এবং টোকা দেওয়া খেলোয়াড়কে সনাক্ত করতে বলা হয়। যদি সে তাকে সনাক্ত করতে পারে তাহলে সে লাফ দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আর যদি না সনাক্ত করতে পারে তবে টোকা দেওয়া খেলোয়াড়টি লাফ দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। দু দলের মধ্যে পর্যায়ক্রমে খেলা শেষে যে দল অপর পক্ষের কোর্ট এ পৌছতে পারে সে দলকেই বিজয়ী হিসাবে গন্য করা হয়। 

গুটি খেলাঃ 

কুতকুত খেলাঃ কুতকুত খেলাটি সাধারনত গ্রামের কিশোরী মেয়েরা খেলে থাকে। এক্ষেত্রে দুজন বা তিনজন খেলোয়াড় থাকে। প্রতি খেলোয়াড়ের কাছে থাকে একটি করে মাটির চাড়া। মোট ছয়টি কোর্ট থাকে কুতকুত খেলায়। প্রথমে একজন খেলোয়াড় তার চাড়াটি প্রথম কোর্টে রেখে একপা উঁচু করে আরেক পা এর সাহায্যে চাড়াটি কুতকুত করে এক নিঃশ্বাসে সব কোর্ট পার করতে হবে। চাড়াটি কোন দাগ স্পর্শ করলে পরবর্তী খেলোয়াড়ের পালা আসবে। চাড়াটি পাশের দাগ অতিক্রমও করতে পারবে না। আর যদি প্রথম খেলোয়াড় চাড়াটি এক নিঃশ্বাসে  সবগুলো কোর্ট পার করতে পারে তবে সে কোর্টগুলো পেছনে রেখে দাড়াবে এবং আপ বলে মাথার উপর দিয়ে চাড়াটি একটি কোর্টে ফেলবে। যে কোর্টে চাড়াটি পড়বে সেই কোর্ট তার কেনা হয়ে যাবে। সেই কোর্টে অপর খেলোয়াড় পা রাখতে পারবে না, লাফিয়ে কোর্টটি পার হতে হবে। যে বেশি কোর্ট কিনতে পারবে সইে বিজয়ী বলে গন্য হবে। কোর্টগুলোকে যথাক্রমে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌকা, পাঞ্জা ও ছক্কা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। 

মোরগ লড়াইঃ মোরগ লড়াই গ্রামাঞ্চলে একটি জনপ্রিয় খেলা। সাধারণত বড়দের অনুপ্রেরণায় ছোটরা এই খেলাটি খেলে থাকে। এ খেলায় একটি বৃত্ত তৈরী করা হয়। সেই বৃত্তের ভেতর খেলোয়াড়রা এক পা উঁচু করে লাফাতে থাকে। এই লাফানো অবস্থায় একজন অন্যজনকে আঘাত করে তার তার গুছিয়ে রাখা পাটি মাটিতে ফেলানোর চেষ্টা করবে। যার পা মাটিতে পড়ে যাবে তার খেলা বাদ। যে সর্বশেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে পা উঁচু করে সেই বিজয়ী বলে গন্য হবে।

কুক-কুলিঃ আমাদের গ্রামাঞ্চলে ছোট ছেলে-মেয়েরা কুক-কুলি খেলে থাকে। অনেক স্থানে এটাকে পলাপলি খেলাও বলা হয়। এ খেলায় একজন চোর থাকবে। তাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে কিছু সময়। এসময়ে অন্যরা লুকিয়ে যাবে।  লুকিয়ে থাকা খেলোয়াড়দেরকে চোর খুঁজে বের করবে। লুকিয়ে থাকা খেলোয়াড়েরা মাঝে-মাঝে কুক-কুলি শব্দ উচ্চারণ করবে। চোর খেলোয়াড়টি যাকে খুঁজে বের করতে পারবে সেই হবে নতুন চোর। এভাবেই খেলা এগিয়ে যেতে থাকে। 

বাঘ-বন্দিঃ বাঘ বন্দি খেলায় মাটিতে কোর্ট কেটে বিভিন্ন বয়সী মানুষ বাড়ির বারান্দায়, আঙিনা বা বাগান বাড়িতে, কাজের ফাঁকে মাঠে বসে এ খেলা খেলে অবসর সময় কাটায়। বাঘ বন্দি খেলায় একজন খেলোয়াড় বাঘের প্রতীকী গুটি এবং অন্যজন সাতটি ছাগলের প্রতীকী গুটি বসিয়ে বাঘ-বন্দি খেলা খেলে। ছাগলগুলো চেষ্টায় থাকে বাঘকে আটকে ফেলার। আর বাঘের চেষ্টা থাকে একটি ছাগলকে খেয়ে অন্য ফাঁকা ঘরে লাফিয়ে যাওয়া। যদি ফাঁকা ঘর না থাকে তবে বাঘটি আটকা পড়ে যায়। বাঘ সব ছাগলগুলোকে খেতে পারলে সে বিজয়ী হবে। আর ছাগল বাঘকে ঘিরে ফেলতে পারলে ছাগল প্রতীকের খেলোয়াড় জয়ী হবে। 

ষোলপাতে/বারপাতেঃ ষোল পাতে বা বার পাতে খেলাও বাঘ-বন্দি খেলার নিয়মে খেলা হয়। ষোল পাতে খেলায় দু’পক্ষের মোট ৩২টি গুটি থাকে এবং বার পাতে খেলায় ২৪টি গুটি থাকে। 

রাম সাম যদু মধুঃ অবসর সময়ে ছেলেমেয়েরা রাম সাম যদু মধু নামে খেলাটি খেলে থাকে। অনেকটা তাস খেলার মতো অনুভ‚তি কাজ করে এ খেলায়। মোট ষোলটি কাগজে প্রতিটি শব্দ চারটি কাগজে লেখা হয়। চারজনের মধ্যে খেলাটি সম্পন্ন হয়। প্রথমে চারজনের মধ্যে কাগজগুলো এলোমেলো করে বণ্টনের পর হাত ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে। যদি চারটি এক শব্দ কারো হাতে মিলে যায় তবে সেই বিজয়ী হবে। খেলাটি সমাপ্ত হবে। পুনঃবন্টনের মাধ্যমে খেলাটি আবার শুরু হয়। 

এছাড়াও গুটি খেলা, দারোগা-পুলিশ-চোর-ডাকাতÑ এরকম অসংখ্য লোকজ খেলা প্রচলিত ছিল আমাদের সমাজে। অনেক খেলার অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। তবে দু’দশক আগেও খেলাগুলোর যে আবেগ ও আকর্ষণ ছিল এখন আর সেটা পরিলক্ষিত হয় না আমাদের বর্তমান প্রজন্মের ছেলেেেময়েদের মধ্যে। আকাশ সংস্কৃতি, কম্পিউটার, মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছে সেই সব গ্রামীন আবেগ-অনুভ‚তি। বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তির প্রতিযোগীতা গ্রামীন উৎসব, খেলাধুলা, আতিথেয়তা, বসবাস ও কথনরীতি সবকিছুকেই কংক্রিট করে দিচ্ছে। আর যাকিছু লোকজ বলে প্রদর্শিত হয় সবকিছুতেই যেন কৃত্রিমতা ভর করে থাকে। 

লোকজ ক্রীড়ার কৌশল বিষয়ে তথ্যপ্রদানকারীঃ 

মোঃ তৌহিদুজ্জামান 

বয়সঃ ৩৫ বছর

ক্রীড়া শিক্ষক

অমরেশ বসু ডিগ্রি কলেজ, আলোকদিয়া, মাগুরা। 

লোক-ক্রীড়ার অন্যান্য তথ্যপ্রদানকারীঃ

লিয়াকত আলী মুন্সী, চেয়ারম্যান, গোপালগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ 

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, চেয়ারম্যান, কুচিয়ামোড়া ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা 

খন্দকার মহব্বত আলী,  চেয়ারম্যান, বেরোইল পলিতা ইউনিয়ন পরিষদ, মাগুরা

মোঃ.কেছমত আলী ও মোঃ ছেকেন্দার আলী, সদস্য চাউলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ অলিয়ার রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জগদল ইউনিয়ন পরিষদ 

আঃ লতিফ বিশ্বাস চেয়ারম্যান, মঘী ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ বকুল মুন্সী (৬০), দক্ষিণ মির্জাপুর, গ্রামপুলিশ

মোঃ রেজাউল করিম, প্রাক্তন ইউপি মেম্বর, হাজরাপুর ইউনিয়ন পরিষদ

মোঃ খবির আহমেদ, সচিব, কচুন্দি ইউনিয়ন পরিষদ

প্রফেসর মুন্সি আজীজুল হক (অব), হাজীপুর, মাগুরা

মন্তব্য: