1. লোক

মাগুরা অঞ্চলের লোকযান

মাগুরা সদর উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের লোকযান রয়েছে। বলা যায়, গ্রাম বাংলার প্রতিটি লোকযানই এই উপজেলায় রয়েছে। এসব লোকযানগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসা-বানিজ্য প্রসারে, কৃষি উৎপাদিত পন্য আদান প্রদানে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের জন্য এবং বিভিন্ন লোকজ উৎসবে এইসব লোকযানগুলো ব্যবহার করে।  

নৌকাঃ মাগুরা জেলা নদী বিধৌত একটি জেলা। মাগুরা সদর উপজেলাটি কুমার নদ, নবগঙ্গা, মধুমতি ও ফটকি নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমানে বিল, খাল, হাওড় ও বাওড়। জলাধার পরিবেষ্টিত হওয়ায় এখানে প্রধান লোকযান হলো নৌকা । নৌকা বাহনটি প্রধানত কৃষিজ ও ব্যবসায়িক পন্য এ জেলা থেকে অন্য জেলায় পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়। মাছ ধরার কাজে নৌকা প্রধান উপাদান। এ জেলায় তৈরীকৃত মৃতশিল্পের পন্য যেমন হাড়ি, কোলা, চাড়ি, মালসা, কলসিসহ অন্যান্য সামগ্রি জলপথেই পরিবহন করা হয়। এছাড়া এসব নদীপথে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ বনভোজনেও অংশগ্রহন করে থাকে। 

ডুঙ্গাঃ মাগুরা জেলায় এক সময় প্রচুর পরিমানে তাল গাছ দেখা যেত। আর এই তালগাছ থেকে তৈরী করা হতো ডুঙ্গা। ডুঙ্গা নামক এই জলযানটি এখনও মাগুরা অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে দেখা যায়। বিভিন্ন বিল, খাল ও নদীতে জেলেদেরকে এখনও ডুঙ্গায় চড়ে মাছ ধরতে দেখা যায়। ডুঙ্গায় চড়ে বড়শি পেতে মাছ ধরার দৃশ্যটি মাগুরায় খুবই পরিচিত। 

ভেলাঃ কলাগাছ কেঁটে, ভেতরে বাঁশের কঞ্চি কিংবা চিকন বাঁশ ঢুকিয়ে কয়েকটি কলাগাছ সারি সারি করে আঁটোসাটে করে তৈরী করা হয় ভেলা। গ্রাম অঞ্চলে এটাকে ভেওয়াও বলা হয়। এই ভেলা সাধারণত বন্যা কবলিত হওয়ার সময় মাগুরার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। ভেলায় চড়ে মানুষ তখন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাতায়াত করে থাকে। তাছাড়া, পুকুর, বিল, হাওড় ও জলাবদ্ধ অঞ্চলে মাছ ধরার কাজেও ভেলা ব্যবহার করা হয়। জেলার শ্রোতহীন জলাশয়গুলোতে ভেলায় চড়ে ছাতা মাথায় বড়শি ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। এছাড়া গ্রামের কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েদেরকে শখের বশে কলাগাছের ভেলা তৈরী করে খেলতে দেখা যায়। 

গরুর গাড়িঃ মাঠ থেকে ফসল বাড়িতে বয়ে আনতে মাগুরা জেলা প্রায় প্রতিটি গ্রামেই গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হয়। মাগুরা শহর থেকে দূরবর্তী গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারেই গরুর গাড়ি দেখা যায়।  গরুর গাড়িতে কাঠের চাকা ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য অংশ তৈরী করা হয় বাঁশ দ্বারা। 

মহিষের গাড়িঃ মহিষের গাড়ি দেখতে গরুর গাড়ির সদৃশ। তবে মহিষের গাড়ি গরুর গাড়ির তুলনায় বেশি মজবুত করে তৈরী করা হয়। এবং মালামালও বেশি বহন করা যায়। গরুর গাড়ির প্রাচুর্য যতটা বেশি দেখা যায়, মহিষের গাড়ির আধিক্য অতটা বেশি নয়। এবং সব অঞ্চলে মহিষের গাড়ি দেখাও যায় না।  

ঘোড়ার গাড়িঃ  মাগুরা জেলার কিছু এলাকায় এখনও ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায়। তবে এর পরিমান ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এখানকার ঘোড়ার গাড়িগুলো অনেকটা গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ির মতোই। এক ঘোড়া চালিত ঘোড়ার গাড়িই মাগুরা অঞ্চলে দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী এলাকায় মালামাল বহন করতে ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়। শুধ মালামাল নয় লোক বহনেও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করা হয়। ঘোড়ার গাড়ির চাকায় লোহার বেড়ি পেচিয়ে দেওয়া হয়। কারণ ঘোড়ার গাড়িকে কাঁচা ও পাকা উভয় রাস্তায় চলাচল করতে হয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঘোড়ার গাড়ির চাকা হিসাবে টায়ারের চাকা ব্যবহার করা হচ্ছে।  

সাইকেলঃ দুই চাকায় চালিত ও লোকবাহিত একটি অতি পরিচিত লোকযান সাইকেল। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাতেই এই বাহনটি দেখা যায়। তবে গ্রাম অঞ্চলে সাইকেলের পেছনেও মালামাল বহনের দৃশ্য দেখা যায়। বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায় তাদের মাছের পোনা হাড়িতে করে সাইকেলের পেছনে বিভিন্ন স্থানে বহন করে থাকে।  

ভ্যানঃ তিন চাকায় চালিত মানুষ বাহিত একটি লোকযান হলো ভ্যান। মালামাল ও লোক বহনে গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প যান এটি। এর আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে গ্রামের রাস্তা-ঘাট পাকা হয়ে যাওয়ার কারণে। এই যানটি শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় দেখা যায়। 

রিকশাঃ মাগুরা জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোতে লোক বাহিত তিন চাকার রিকশার প্রচলন তেমন না থাকলেও মাগুরা সদরের পৌর এলাকায় এই যানটির প্রচুর পরিমানে লক্ষ্য করা যায়। শহর এলাকায় এই যানটি লোক বহনের অতি প্রয়োজনীয় মাধ্যম।  

পালকীঃ মাগুরা সদর উপজেলার কুশাবাড়িয়া গ্রামে বিহারা সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। নিকট অতীতে এই সম্প্রদায়ের লোকজন পালকীতে নববিবাহিত বর-কনেকে  বহন করে জীবিকা নর্বাহ করতো। স্বরচিত গান গেয়ে এসব বিহারা গ্রাম থেকে গ্রামে পালকীতে বহন করে নিয়ে যেত বর-বধু। পালকীতে মিশে থাকতো তাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষ আর তার সভ্যতা যান্ত্রিক হওয়ার কারণে বিলুপ্ত হয়েছে পালকীতে বিবাহ প্রথা। এখন আর একটিও পালকী পাওয়া যায়না এই সম্প্রদায়ের  বসতি এলাকায়। জীবিকার প্রয়োজনে তারা বেছে নিয়েছে অন্য পেশা। এখন কেউ চুল কাটে, কেউ মাছ বিক্রি করে, কেউ টিনের ঘরের মিস্ত্রি, কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ আবার কৃষি কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। এই গ্রামের সুনামধন্য বিহারাদের মধ্যে অমূল্য বিহারা, গৌর বিহারা, নিতাই বিহারা, প্রফুল্ল বিহারা, মন্টু বিহারা, স্বপন বিহারা প্রমুখ। এলাকায় এরা কাহার সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। এই বিহারাদের পূর্বপুরুষ বাবুরাম বিহারা, শতীষ বিহারা, নীলমনি বিহারা ও লক্ষিকান্ত বিহারা জমিদার ছিলেন। [তথ্য- অজিৎ বিহারা (৭০), পিতা- গোপাল বিহারা, কুশাবাড়িয়া, মাগুরা।]

বিবর্তনঃ উপরোক্ত লোকযানগুলো আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হলেও এগুলোর জৌলুষ হারাতে বসেছে। জলযানগুলোর অবস্থান অপরিবর্তিত থাকলেও জেলার অধিকাংশ রাস্তা পাকা হয়ে যাওয়ায় পরিবহনের ক্ষেত্রেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন মানুষ ধীরগতির গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি ও মহিষের গাড়িতে মালামাল বহনে স্বাচ্ছন্দ হারিয়ে ফেলছে। এসব লোকযানের স্থানে মানুষ এখন যন্ত্রচালিত গাড়ি যেমন নসিমন, করিমন, গ্রাম বংলা, টেম্পু নামক পরিবহনগুলো ব্যবহার করছে। এছাড়া এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় যাতায়াত করতে ও মালামাল বহন করতে মানুষ ব্যবহার করছে বাস, প্রাইভেট, মাইক্রো ও ট্রাক। 

তথ্যসূত্রঃ মাগুরা জেলার লোকাচার্যের বিভিন্ন উপাত্ত সন্ধানে মাগুরা সদর উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে সংগ্রাহকের সচক্ষে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে লিখিত।   

মন্তব্য: